তারাবীহ ২০ রাকআতের পক্ষে আহলুস্ সুন্নাহ’র ফতোয়া
[Bengali translation of www.ahlus-sunna.com's fatwa on Taraweeh prayers during the holy month of Ramadaan; translated by Kazi Saifuddin Hossain; Arabic quotes and online set-up by brother-in-Islam and Facebook friend Mahmud Hasan]
মূল: ডব্লিউ,ডব্লিউ,ডব্লিউ-ডট-আহলুস্ সুন্নাহ-ডট-কম
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
[অনুবাদকের উৎসর্গ: পীর ও মোর্শেদ আউলিয়াকুল শিরোমণি হযরত মওলানা শাহ সূফী আলহাজ্জ্ব সৈয়দ এ, জেড, এম, সেহাবউদ্দীন খালেদ আল-কাদেরী আল-চিশ্তী রহমতুল্লাহে আলাইহের পুণ্যস্মৃতিতে...]
পবিত্র রমযান মাসে তারাবীহ’র নামায কতো রাকআত পড়তে হয়, তা নিয়ে যথেষ্ট বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। মুসলমানদের ভালো করে জানা আবশ্যক যে বিগত ১৪’শ বছর ধরে মুসলিম উম্মাহ ন্যূনতম ২০ রাকআত তারাবীহ নামায পড়ে আসছেন (এর অন্তর্ভুক্ত হারামাইন শরীফাইন-ও)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ), সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه), তাবেঈন ও পূর্ববর্তী উলামা (رحمة الله عليه)-এর যুগ থেকে এটি চলে আসছিল; হেজাযে একটি নতুন ফেরকাহ’র উৎপত্তি-ই মুসলমানদের এতদসংক্রান্ত ঐক্যকে বিনষ্ট করেছে। ওই ফেরকাহ’র সম্বল একটিমাত্র হাদীস যা ‘তাহাজ্জুদ’ নামায-সম্পর্কিত; এই হাদীসের অপব্যাখ্যা করে সেটিকে তারা তারাবীহ’র প্রতি আরোপ করে থাকে এবং মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করে।
তারাবীহ’র নামায যে ২০ রাকআত, তা অজস্র দলিলের আলোকে আমরা এক্ষণে দেখবো।
তারাবীহ নামাযের ২০ রাকআতের পক্ষে একচেটিয়া দলিল প্রদর্শনের আগে আমরা দেখাবো যে ইসলামী শরীয়তে ‘সুন্নাহ’ শব্দটির ব্যাখ্যা একটি সহীহ হাদীসে কীভাবে এসেছে। বিভ্রান্ত ফেরকাহ’র কিছু লোক তারাবীহ নামাযের ব্যাপারটিতে নিজেদের অপযুক্তি খণ্ডন হতে দেখে আর কোনো উপায় না পেয়ে বলে, হযরত উমর (رضي الله عنه) ও অন্যান্য সাহাবা (رضي الله عنه)-বৃন্দের ধর্ম অনুশীলন এক কথা, আর মহানবী (ﷺ)-এর ধর্মচর্চা একদম আলাদা বিষয়। আরেক কথায়, তারা সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-কে মহানবী (ﷺ)-এর সাথে ভিন্নমত পোষণের অভিযোগে অভিযুক্ত করে। (নাউযুবিল্লাহ)
কিন্তু এই অভিযোগকারীদের অবাক করে হযরত নবী করীম (ﷺ) এরশাদ ফরমান:
“তোমরা আমার সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরো এবং আমার সঠিক পথের অনুসারী খলীফাবৃন্দের সুন্নাহকেও।” [সুনানে আবি দাউদ, ২য় খণ্ড, ৬৩৫ পৃষ্ঠা, সুনানে তিরমিযী, ২য় খণ্ড, ১০৮ পৃষ্ঠা, সুনানে দারিমী, ১ম খণ্ড, ৪৩ পৃষ্ঠা, ইবনে মাজাহ ও অন্যান্য]
দলিল-১
أخبرنا أبو طاهر الفقية، قال: أخبرنا أبو عثمان البصري، قال: حدثنا أبو أحمد: محمد بن عبد الوهاب، قال: أخبرنا خالد بن مخلد، قال: حدثنا محمد بن جعفر، قال: حدثني يزيد بن خصيفة، عن السائب بن يزيد، قال: كنا نقوم في زمان عمر بن الخطاب بعشرين ركعة والوتر.
অর্থাৎ, হযরত সাঈব ইবনে এয়াযীদ (رضي الله عنه) বলেন, “খলীফা হযরত উমর ফারূক (رضي الله عنه)-এর আমলে (রমযান মাসে) মুসলমান সমাজ ২০ রাকআত (তারাবীহ) নামায এবং বিতরের নামাযও পড়তেন।”
[সূত্র: ইমাম বায়হাকী প্রণীত ‘মা’রেফত-উস-সুনান ওয়াল্ আসার’, ৪র্থ খণ্ড, ৪২ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ৫৪০৯]
ইমাম বায়হাকী (رحمة الله عليه) অপর এক সনদে অনুরূপ একখানি রওয়ায়াত লিপিবদ্ধ করেছেন:
وقد أخبرنا أبو عبد الله الحسين بن محمد بن الحسين بن فنجويه الدينوري بالدامغان ثنا أحمد بن محمد بن إسحاق السني أنبأ عبد الله بن محمد بن عبد العزيز البغوي ثنا علي بن الجعد أنبأ بن أبي ذئب عن يزيد بن خصيفة عن السائب بن يزيد قال كانوا يقومون على عهد عمر بن الخطاب رضي الله عنه في شهر رمضان بعشرين ركعة قال وكانوا يقرؤون بالمئين وكانوا يتوكؤن على عصيهم في عهد عثمان بن عفان رضي الله عنه من شده القيام
অর্থাৎ, হযরত সাঈব ইবনে এয়াযীদ (رضي الله عنه) বলেন, “খলীফা হযরত উমর ইবনে আল-খাত্তাব (رضي الله عنه)-এর শাসনামলে রমযান মাসে মুসলমানগণ ২০ রাকআত (তারাবীহ) নামায পড়তেন।” তিনি আরও বলেন, “তাঁরা মি’ঈন পাঠ করতেন এবং খলীফা হযরত উসমান ইবনে আফফান (رضي الله عنه)-এর শাসনামলে (নামাযে) দণ্ডায়মান থাকার অসুবিধা থেকে স্বস্তির জন্যে তাঁরা নিজেদের লাঠির ওপর ভর দিয়ে দাঁড়াতেন।”
[সূত্র: ইমাম বায়হাকী রচিত ‘সুনান আল-কুবরা’, ২য় খণ্ড, ৬৯৮-৯ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ৪৬১৭]
ইমাম নববী (رحمة الله عليه) বলেন, “এটির এসনাদ সহীহ (بإسناد صحيح)।”
[সূত্র: ‘আল-খুলাসাতুল আহকাম’, হাদীস নং ১৯৬১]
ইমাম বদরুদ্দীন আয়নী (رحمة الله عليه) বলেন:
رواه البيهقي بإسناد صحيح عن السائب بن يزيد الصحابي، قال: كانوا يقومون على عهد عمر ، رضي الله تعالى عنه، بعشرين ركعة، وعلى عهد عثمان وعلي، رضي الله تعالى عنهما، مثله
অর্থাৎ: “ইমাম বায়হাকী (رحمة الله عليه) সহীহ সনদে সাহাবী হযরত সাঈব ইবনে এয়াযীদ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন যে খলীফা হযরত উমর ফারূক (رضي الله عنه)-এর শাসনামলে মুসলমান সমাজ ২০ রাকআত (তারাবীহ) নামায পড়তেন এবং তা খলীফা হযরত উসমান (رضي الله عنه)-এর শাসনামলেও প্রচলিত ছিল।”
[সূত্র: ’উমদাতুল ক্কারী শরহে সহীহ আল-বোখারী’, ৫ম খণ্ড, ২৬৪ পৃষ্ঠা; দারুল ফিকর, বৈরুত, লেবানন হতে প্রকাশিত]
’সালাফী’ আলেম আল-মোবারকপুরীও এই হাদীসটির সনদকে ’সহীহ’ বলেছে এবং এর পক্ষে ইমাম নববী (رحمة الله عليه)-এর সমর্থনের কথা উদ্ধৃত করেছে।
[সূত্র: ’তোহফাতুল আহওয়াযী’, ৩য় খণ্ড, ৪৫৩ পৃষ্ঠা; দারুল ফিকর, বৈরুত, লেবানন থেকে প্রকাশিত]
ইমাম নববী (رحمة الله عليه) বলেন:
رجال هذا الاسناد كلهم ثقات
অর্থাৎ: “এই এসনাদে সকল রাবী তথা বর্ণনাকারী ’সিকা’ বা নির্ভরযোগ্য।”
[‘আসার আল-সুনান’, ২:৫৪]
দলিল-২
و حدثني عن مالك عن يزيد بن رومان أنه قال
كان الناس يقومون في زمان عمر بن الخطاب في رمضان بثلاث وعشرين ركعة
অর্থাৎ, এয়াহইয়া আমার (ইমাম মালেক) কাছে মালেক (رحمة الله عليه) হতে বর্ণনা করেন যে এয়াযীদ ইবনে রুমান বলেছেন, “খলীফা হযরত উমর ইবনে আল-খাত্তাব (رضي الله عنه)-এর শাসনামলে মুসলমানবৃন্দ রমযান মাসের (প্রতি) রাতে ২৩ রাকআত (তারাবীহ ২০ ও বিতর ৩) নামায পড়তেন।”
[সূত্রঃ ইমাম মালেক প্রণীত ‘মুওয়াত্তা’, সালাত অধ্যায়, মা জা’আ ফী কায়ামে রমযান, ১ম খণ্ড, ১৫৯ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ৩৮০]
ইমাম তিরমিযী (রহ:)-এর অভিমতঃ
وأَكْثَرُ أهْلِ العِلمِ على ما رُوِيَ عن عليٍّ وعُمر وغَيْرِهِمَا مِنْ أَصحابِ النبيِّ عِشْرِينَ رَكْعَةً. وَهُوَ قَوْلُ الثَّوْرِيِّ وابنِ المُبَارَكِ والشَّافِعيِّ رحمه الله. وقَالَ الشَّافِعيُّ: وهَكَذَا أدْرَكْتُ بِبَلَدِنَا بِمَكَّةَ، يُصَلُّونَ عِشْرِينَ رَكْعَةً
অর্থাৎ, ”ইসলামী জ্ঞান বিশারদদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ একমত হয়েছেন যে (তারাবীহ) নামায ২০ রাকআত, যা হযরত উমর ফারূক(رضي الله عنه), হযরত আলী (رضي الله عنه) এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অন্যান্য সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত হয়েছে। হযরত সুফিয়ান সাওরী (رحمة الله عليه), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক (رحمة الله عليه) এবং ইমাম শাফেঈ (رحمة الله عليه)-ও অনুরূপ মত পোষণ করেছেন। ইমাম শাফেঈ (رحمة الله عليه)বলেন তিনি মক্কার অধিবাসীদেরকে ২০ রাকআত (তারাবীহ) নামায পড়তে দেখেছেন।”
[সূত্র: ‘সুনানে জামেঈ আল-তিরমিযী’, রোযা সংক্রান্ত বই, রমযানের নামায অধ্যায়, ৩য় খণ্ড, ১৬৯ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ৮০৬]
দলিল-৩
حَدَّثَنَا حُمَيْدُ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ ، عَنْ حَسَنٍ ، عَنْ عَبْدِ الْعَزِيزِ بْنِ رُفَيْعٍ ، قَالَ كَانَ أُبَيّ بْنُ كَعْبٍ يُصَلِّي بِالنَّاسِ فِي رَمَضَانَ بِالْمَدِينَةِ عِشْرِينَ رَكْعَةً وَيُوتِرُ بِثَلاَثٍ.
অর্থাৎ, হযরত আবদুল আযীয বিন রাফি’ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: “হযরত উবাই ইবনে কাআব (رضي الله عنه) মদীনা মোনাওয়ারায় রমযান মাসে ২০ রাকআত (তারাবীহ) নামাযের জামা’তে ইমামতি করতেন।”
[সূত্র: মোসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, ৫ম খণ্ড, ২২৪ পৃষ্ঠা, ৭৭৬৬ নং হাদীস]
দলিল-৪
أخبرنا أبو الحسن بن الفضل القطان ببغداد أنبأ محمد بن أحمد بن عيسى بن عبدك الرازي ثنا أبو عامر عمرو بن تميم ثنا أحمد بن عبد الله بن يونس ثنا حماد بن شعيب عن عطاء بن السائب عن أبي عبد الرحمن السلمي عن على رضي الله عنه قال دعا القراء في رمضان فأمر منهم رجلا يصلي بالناس عشرين ركعة قال وكان علي رضي الله عنه يوتر بهم وروى ذلك من وجه آخر عن علي
অর্থাৎ, আবদুর রহমান সুলামী বর্ণনা করেন যে হয়রত আলী (رضي الله عنه) রমযান মাসে কুরআন মজীদ তেলাওয়াতকারী (হাফেয)-দের ডেকে তাদের মধ্যে একজনকে ২০ রাকআত (তারাবীহ) নামায পড়াতে বলেছিলেন এবং নিজে বিতরের নামাযে ইমামতি করতেন।
[সূত্র: ইমাম বায়হাকী কৃত ’সুনান আল-কুবরা’, ২য় খণ্ড, ৬৯৯ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ৪৬২০]
দলিল-৫
عَنِ الْحَسَنِ أَنَّ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ جَمَعَ النَّاسَ عَلَى أُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ فِي قِيَامِ رَمَضَانَ، فَكَانَ يُصَلِّي بِهِمْ عِشْرِينَ رَكْعَةً
অর্থাৎ, হযরত হাসান বসরী (رحمة الله عليه) বলেন: “খলীফা উমর ফারূক (رضي الله عنه) রমযান মাসের (তারাবীহ) নামাযে হযরত উবাই ইবনে কাআব (رضي الله عنه)-এর ইমামতিতে মানুষদেরকে জামা’তে কাতারবদ্ধ করেন এবং তিনি (ইবনে কাআব) ২০ রাকআত নামায পড়ান।”
[সূত্র: ‘সিয়ার আল-আ’লম ওয়াল নুবালাহ’, ১ম খণ্ড, ৪০০-১ পৃষ্ঠা, হযরত উবাই ইবনে কাআব (রা:)-এর জীবনী]
ইমাম নববী (رحمة الله عليه) ওপরের বর্ণনা সম্পর্কে বলেন:
بإسناد صحيح
অর্থাৎ, “এর সনদ সহীহ।”
[সূত্র: ‘আল-খুলাসাত আল-আহকাম’, হাদীস নং ১৯৬১]
দলিল-৬
حَدَّثَنَا وَكِيعٌ ، عَنْ حَسَنِ بْنِ صَالِحٍ ، عَنْ عَمْرِو بْنِ قَيْسٍ ، عَنِ أَبِي الْحَسْنَاءِ أَنَّ عَلِيًّا أَمَرَ رَجُلاً يُصَلِّي بِهِمْ فِي رَمَضَانَ عِشْرِينَ رَكْعَةً
অর্থাৎ, হযরত আবূল হাসনা বর্ণনা করেন যে হযরত আলী (رضي الله عنه) জনৈক ব্যক্তিকে রমযান মাসে ২০ রাকআত (তারাবীহ) নামাযে ইমামতি করার নির্দেশ দেন।”
[সূত্র: ’মোসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা’, ৫ম খণ্ড, ২২৩ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ৭৭৬৩]
দলিল-৭
حَدَّثَنَا وَكِيعٌ ، عَنْ نَافِعِ بْنِ عُمَرَ ، قَالَ كَانَ ابْنُ أَبِي مُلَيْكَةَ يُصَلِّي بِنَا فِي رَمَضَانَ عِشْرِينَ رَكْعَةً، وَيَقْرَأُ بِحَمْدِ الْمَلاَئِكَةِ فِي رَكْعَةٍ
অর্থাৎ, হযরত নাফে’ ইবনে উমর (رضي الله عنه) থেকে ওয়াকী’ বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: “হযরত ইবনে আবি মুলাইকা (رضي الله عنه) রমযান মাসে আমাদের জামা’তের ২০ রাকআত (তারাবীহ) নামাযে ইমামতি করতেন।”
[সূত্র: মোসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, ৫ম খণ্ড, ২২৩ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ৭৭৬৫]
দলিল-৮, ৯ ও ১০ এবং ভ্রান্তদের হাদীস অপপ্রয়োগের বিস্তারিত খণ্ডন
عن ابن عباس رضي الله عنه أن النبي صلى الله عليه وسلم كان يصلي في شهر رمضان في غير جماعة عشرين ركعة والوتر
অর্থাৎ, হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে মহানবী (ﷺ) রমযান মাসে (প্রতি রাতে) নিজে নিজে ২০ রাকআত (তারাবীহ) নামায আদায় করতেন এবং এরপর ৩ রাকআত বেতরের নামাযও পড়তেন।
[সূত্র: ‘সুনান আল-বায়হাকী, হাদীস নং ১২১০২]
عن ابن عباس رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان يصلي في رمضان عشرين ركعة والوتر
অর্থাৎ, হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) রওয়ায়াত করেন যে রাসূলে পাক (ﷺ) রমযান মাসে ২০ রাকআত (তারাবীহ) নামায আদায় করতেন এবং এরপর ৩ রাকআত বেতরের নামাযও আদায় করতেন।
[সূত্র: ’মোসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা’, ২য় খণ্ড, হাদীস নং ৭৬৯২]
حديث أنه صلى الله عليه وسلم صلى بالناس عشرين ركعة ليلتين فلما كان في الليلة الثالثة اجتمع الناس فلم يخرج إليهم ثم قال من الغد خشيت أن تفرض عليكم
অর্থাৎ, হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, বিশ্বনবী (ﷺ) দুই রাতে ২০ রাকআত নামায মানুষের সাথে আদায় করেন; কিন্তু তিনি তৃতীয় রাতে আর বের হননি। তিনি বলেন, আমি আশঙ্কা করি যে এটি তোমাদের (সাহাবা-এ-কেরামের) প্রতি আবার বাধ্যতামূলক না হয়ে যায়।
[সূত্র: ইবনে ইবনে হাজর আসকালানী (رحمة الله عليه) কৃত ‘আল-তালখীস আল-হাবীর’, ২য় খণ্ড, হাদীস নং ৫৪০]
বি:দ্র: ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী (رحمة الله عليه) এই হাদীস উদ্ধৃত করার পরে বলেন,
متفق على صحته من حديث عائشة دون عدد الركعات
অর্থাৎ, “সকল মোহাদ্দেসীন (হাদীসের বিশারদ) হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) হতে এই বর্ণনার নির্ভরযোগ্যতার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেন, তবে রাকআতের সংখ্যার ক্ষেত্রে নয়।
আহলুল বেদআহ (বেদআতী গোষ্ঠী) আনন্দে আটখানা হয়ে বলে, দেখো, ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী (رحمة الله عليه) এই হাদীসটিকে সহীহ হিসেবে গ্রহণ করেছেন, কিন্তু রাকআতের সংখ্যার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত দেননি। অতএব, তারাবীহ’র নামাযের রাকআতের সংখ্যা কতো তা প্রতিষ্ঠিত নয়।
জবাব: প্রথমতঃ ইমাম ইবনে হাজর (رحمة الله عليه)-এর এই কথা আমাদের বিরুদ্ধে নয়, বরং বেদআতীদের বিরুদ্ধে যায়। কেননা, তারাবীহ নামায ২০ রাকআত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পক্ষে আমাদের কাছে একচেটিয়া দালিলিক প্রমাণ আছে। অথচ তারা দুটো দলিলকে বিকৃত করে কপটতার সাথে দাবি করে যে তারাবীহ’র নামায মাত্র ৮ রাকআত।
তারাবীহ নামায সম্পর্কে বেদআতীদের প্রদর্শিত মূল দলিল হচ্ছে বোখারী শরীফের একখানা হাদীস, যা’তে বিবৃত হয়েছে:
সহীহ বোখারী, তাহাজ্জুদ-বিষয়ক বই, ২য় খণ্ড, ২১তম বই, হাদীস নং ২৪৮
হযরত আবূ সালমা বিন আবদির রহমান (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন: আমি মা আয়েশা (رضي الله عنه)-কে জিজ্ঞেস করলাম, রমযান মাসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামায কেমন ছিল? তিনি জবাবে বলেন, “আল্লাহর রাসূল (ﷺ) রমযান, বা অন্যান্য মাসে কখনোই এগারো রাকআতের বেশি নামায পড়েন নি; তিনি চার রাকআত পড়তেন, সেগুলোর সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্য সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞেস করো না; অতঃপর চার রাকআত পড়তেন, সেগুলোর সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্য সম্পর্কেও আমাকে প্রশ্ন করো না; এবং এরপর তিনি তিন রাকআত নামায পড়তেন।”
মা আয়েশা (رضي الله عنه) আরও বলেন, “আমি বল্লাম, এয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! বেতরের নামায পড়ার আগে কি আপনি ঘুমোন? তিনি উত্তরে বলেন, ’ওহে আয়েশা! আমার চোখ ঘুমোয়, কিন্তু আমার অন্তর (কলব্) জাগ্রত থাকে’।”
সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন যে কেউই এখানে স্পষ্ট দেখতে পাবেন যে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (رضي الله عنه) তাহাজ্জুদ নামায সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। কেননা, তিনি বলেন, “বা অন্যান্য মাসে”; অথচ সালাতুত্ তারাবীহ হলো শুধু রমযান মাসের জন্যেই নির্ধারিত নামায। যদিও আমরা এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা করতে পারি এবং সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করতে পারি যে উপরোক্ত হাদীস শরীফ সুনির্দিষ্টভাবে তাহাজ্জুদ নামাযকে উদ্দেশ্য করেছে এবং তারাবীহ নামাযকে করেনি, তথাপি আমরা আরেকটি বিষয়ের দিকে এক্ষণে মনোযোগ দিতে আগ্রহী। এই হাদীসটি ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী (رحمة الله عليه)-এর ওপরে উদ্ধৃত সিদ্ধান্তের আওতায় পড়ে, অর্থাৎ, “সকল মোহাদ্দেসীন (হাদীসের বিশারদ) হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) হতে এই বর্ণনার নির্ভরযোগ্যতার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেন, তবে রাকআতের সংখ্যার ক্ষেত্রে নয়।”
এবার আমরা সহিহাইন (বোখারী ও মুসলিম) হতে দালিলিক প্রমাণগুলো যাচাই করবো।
সহীহ বোখারী, ২য় খণ্ড, ২১তম বই, হাদীস নং ২৬১
হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন: “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রাতের নামাযে তেরো (১৩) রাকআত পড়তেন এবং ফজরের নামাযের আযান শোনার পর তিনি দুই রাকআত (হাল্কা, দীর্ঘ নয়) নামায আদায় করতেন।”
এই হাদীস প্রমাণ করে তাহাজ্জুদ (বেতর ছাড়াই) অন্ততপক্ষে ১০-১২ রাকআত-বিশিষ্ট নামায। অথচ এই বেদআতীরা ৮ রাকআতকে মহানবী (ﷺ)-এর সুন্নাহ হিসেবে মনে করে। এই কারণেই ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী (رحمة الله عليه) হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) থেকে উপরোক্ত ২০ রাকআতের বর্ণনাসম্বলিত হাদীসটিকে ’সহীহ’ বলেছেন, কিন্তু রাকআতের সংখ্যার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেন নি।
সহীহ বোখারী, ২য় খণ্ড, ২১তম বই, হাদীস নং ২৪০
মাসরুখ (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, আমি মা আয়েশা (رضي الله عنه) -কে মহানবী (ﷺ)-এর রাতের নামায সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “ফজরের দুই রাকআত (অর্থাৎ সুন্নাহ) ছাড়াও ওই নামায ছিল সাত, নয় বা এগারো রাকআত-বিশিষ্ট।”
এটিও হযরত আয়েশা (رضي الله عنه)-এর হাদীসে ‘এদতেরাব’ প্রমাণ করে (মানে সাত, নয়, নাকি এগারো তা স্থিরকৃত নয়); আর তারাবীহ কখনোই ৮ রাকআত বলে বিবেচনা করা যায় না, কারণ এর ২০ রাকআত হবার ব্যাপারে ঐকমত্য রয়েছে।
সহীহ মুসলিম, ৪র্থ বই, হাদীস নং ১৬১১
হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত যে, রাতে রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর আদায়কৃত নামাযে রাকআত সংখ্যা ছিল দশ। তিনি বিতরের নামায এবং ফজরের দুই রাকআত (সুন্নাত) নামাযও আদায় করতেন। আর এর যোগফল হচ্ছে তেরো (১৩) রাকআত।
সহীহ মুসলিম, ৪র্থ বই, হাদীস নং ১৬৮৬
আবূ জামরা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন: আমি হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه)-কে বলতে শুনেছি যে মহানবী (ﷺ) রাতে তেরো (১৩) রাকআত নামায পড়তেন।
সহীহ মুসলিম, ৪র্থ বই, হাদীস নং ১৬৮৭
হযরত যায়দ বিন খালেদ আল-জুহানী (رحمة الله عليه) বলেন: ”নিশ্চয় আমি মহানবী(ﷺ) কর্তৃক আদায়কৃত রাতের নামায প্রত্যক্ষ করতাম। তিনি প্রথমে সংক্ষিপ্ত দুই রাকআত নামায পড়তেন; অতঃপর দীর্ঘ, অতি দীর্ঘ দুই রাকআত পড়তেন; এর পরের দুই রাকআত পূর্ববর্তী দুই রাকআতের চেয়ে সংক্ষিপ্ত ছিল; পরবর্তী যে দুই রাকআত পড়তেন, তা আরও সংক্ষিপ্ত; তৎপরবর্তী দুই রাকআত আরও সংক্ষিপ্ত; এর পরে আরও দুই রাকআত পড়তেন যা আরও সংক্ষিপ্ত ছিল। অতঃপর তিনি একটি রাকআত (বিতর) পড়তেন, যা সর্বসাকুল্যে তেরো রাকআত নামায হতো।”
ওপরে প্রদর্শিত আমাদের ৮ এবং ৯ নং দলিল, যার মধ্যে রয়েছে হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) কর্তৃক সরাসরি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হতে প্রদত্ত ২০ রাকআত তারাবীহ নামাযের বর্ণনা, উভয় বর্ণনাতেই অবশ্য আবূ শায়বাহ (মহান মুহাদ্দীস ইবনে আবি শায়বাহ’র বাবা) নামে একজন রাবী (বর্ণনাকারী) আছেন যাঁর নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। অধিকাংশ মুহাদ্দেসীন তাঁকে ‘দুর্বল’ বিবেচনা করেছেন। এমতাবস্থায় এই সকল বেদআতী লোকেরা আবারও আনন্দে লাফ দিয়ে বলে ওঠে যে আবূ শায়বাহ দুর্বল; তাই ২০ রাকআত তারাবীহ হুযূর পাক (ﷺ) থেকে প্রমাণিত নয়। তাদের কথার সমর্থনে তারা নিম্নের হাদীসটি প্রদর্শন করে:
হযরত জাবের ইবনে আব্দিল্লাহ (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, “নবী করীম (ﷺ) রমযান মাসে (এক রাতে) আট রাকআত ও বেতরের নামাযে ইমামতি করেন। পরবর্তী রাতে আমরা মসজিদে সমবেত হই এই আশায় যে তিনি আবারও ইমামতি করার জন্যে বেরিয়ে আসবেন। আমরা সেখানে সকাল পর্যন্ত অবস্থান করি। অতঃপর আমরা মসজিদের মাঝখানে এসে আরয করি, ‘এয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! আমরা গত রাতে মসজিদে অবস্থান করেছি এই আশায় যে আপনি নামাযে ইমামতি করবেন।’ প্রত্যুত্তরে মহানবী (ﷺ) এরশাদ ফরমান, ‘নিশ্চয় আমি আশঙ্কা করেছি এটি তোমাদের প্রতি অবশ্য পালনীয় না হয়ে যায়’।”
[সূত্র: ইবনে খুযাইমাহ (২:১৩৮, হাদীস # ১০৭০), ইমাম তাবারানী কৃত মু’আজম আস্ সাগীর (১:১৯০) এবং অন্যান্যরা]
এই বেদআতীরা নিজেদের হীন স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে যে কোনো হাদীসকে যয়ীফ (দুর্বল) ঘোষণা করতে মোটেও দেরি করে না।
এখন আমরা হযরত জাবের ইবনে আব্দিল্লাহ (رضي الله عنه) হতে জাল হাদীস বর্ণনাকারী সম্পর্কে আল-জারহ ওয়াত্ তা’দীল-বৃন্দ কী বলেছেন তা দেখবো।
এই হাদীসটির ‘একমাত্র’ বর্ণনাকারী ঈসা ইবনে জারিয়াহ; মহান মোহাদ্দেসীনবৃন্দ ও আল-জারহ ওয়াত্ তা’দীল-মণ্ডলীর অভিমত নিচে পেশ করা হলো:
হযরত এয়াহইয়া বিন মঈন (رحمة الله عليه) বলেন:
قال ابن أبـي خيثمة عن ابن معين: ليس بذاك ، لا أعلم أحداً روى عنه غير يعقوب
অর্থাৎ, এই লোক ‘কেউই নয়’ এবং সে যার কাছ থেকে হাদীস নিয়েছে এমন বর্ণনাকারীদের মধ্যে এয়াকুব (শিয়াপন্থী) ছাড়া আর কাউকে আমি জানি না।
[সূত্র: তাহযিবুত্ তাহযিব, ৪:৫১৮]
ইমাম আল-মিযযী (رحمة الله عليه) প্রণীত ‘তাহযিবুল কামাল’ গ্রন্থে ইমাম আবূ দাউদ (رحمة الله عليه)-এর বাণীও বিধৃত হয়েছে, যেখানে তিনি ঈসাকে মুনকার আল-হাদীস ঘোষণা করেন।
وقال أبو عُبـيد الآجُري ، عن أبـي داود: منكر الحديث
অর্থাৎ, যথা, আবূ উবায়দ আল-আজরী ইমাম আবূ দাউদ (رحمة الله عليه)-এর কথা উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন যে ঈসা বিন জারিয়াহ ‘মুনকার আল-হাদীস’।
[সূত্র: তাহযিব আল-কামাল, ১৪তম খণ্ড, ৫৩৩ পৃষ্ঠা]
ইমাম নাসাঈ (رحمة الله عليه) নিজ ‘দু’আফা ওয়াল মাতরুকীন’ গ্রন্থে বলেন,
عيسى ابن جارية: يروي عنه يعقوب القُمِّي، منكر
অর্থাৎ, “ঈসা বিন জারিয়াহ হাদীস গ্রহণ করেছে (শিয়া বর্ণনাকারী) এয়াকুব আল-কুম্মী হতে; আর সে (ঈসা) হচ্ছে ‘মুনকার’।”
[সূত্রঃ ইমাম নাসাঈ কৃত ‘দু’আফা ওয়াল মাতরুকীন, ২:২১৫]
অতএব, ছয়টি বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য হাদীসগ্রন্থের মধ্যে দু’টির রচয়িতা (ইমাম আবূ দাউদ ও ইমাম নাসাঈ) ওই বর্ণনাকারীকে ‘মুনকারুল হাদীস’ ঘোষণা করেছেন বলে সপ্রমাণিত হলো।
ঈসা বিন জারিয়াহ সম্পর্কে অন্যান্য উলামা-এ-কেরাম যা বলেছেন, তা নিম্নরূপ:
قلت: وذكره الساجي، والعقيلي في الضعفاء. وقال ابن عدي: أحاديثه غير محفوظة
অর্থাৎ, ইমাম আল-সা’যী (رحمة الله عليه) ও ইমাম আল-উকাইলী (رحمة الله عليه) ’দু’আফা’ (দুর্বল/অ-নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী)-এর তালিকায় ঈসাকে উল্লেখ করেন।
ইমাম ইবনে আদী (رحمة الله عليه) বলেন, তার বর্ণিত আহাদীস ‘মাহফূয নয়’।
[সূত্র: তাহযিবুত্ তাহযিব, ৪:৫১৮]
ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী (رحمة الله عليه) স্বয়ং বলেন, ঈসা বিন জারিয়াহ ‘লাঈন’ (দুর্বলতাপ্রবণ, অর্থাৎ, অ-নির্ভরযোগ্য)।
[সূত্র: তাকরিবুত্ তাহযিব, ১:৭৬৮]
এমন কি আলবানী ও হুসাইন সালীম আসাদের মতো শীর্ষস্থানীয় ‘সালাফী’-রাও ঈসা বিন জারিয়াহ বর্ণিত এই হাদীসটিকে যয়ীফ বলেছে।
হুসাইন সালীম আসাদ ‘মুসনাদে আবি এয়ালা’ গ্রন্থের নিজস্ব ব্যাখ্যামূলক ’তাহকীক’ পুস্তকে বলে,
إسناده ضعيف
অর্থাৎ, এর সনদ ’দুর্বল’।
[সূত্র: তাহকীক, ৩:৩৩৬, দারুল মা’মূন, দামেশক থেকে প্রকাশিত]
সুতরাং পরিদৃষ্ট হচ্ছে যে আল-জারহ ওয়াত্ তা’দীল তথা হযরত এয়াহইয়া বিন মঈন (رحمة الله عليه), ইমাম নাসাঈ (رضي الله عنه) ও ইমাম আবূ দাউদ (رحمة الله عليه)-এর মতো কর্তৃত্বসম্পন্ন মহান উলামাবৃন্দ ঈসাকে দা’য়ীফ-ই শুধু নয়, বরং মুনকারুল হাদীস-ও বলেছ্নে। এমতাবস্থায় ‘সালাফী’দের প্রদর্শিত এই বর্ণনাটি ‘মওযু’ বা জাল বলেই সাব্যস্ত হয়!
উপমহাদেশে পরিচিত ‘সালাফী’ আলেম মওলানা আবদুর রহমান মোবারকপুরী (মৃত্যু: ১৩৫৩ হিজরী) লিখেছে, যে বর্ণনাকারী (রাবী) মুনকারুল হাদীস বলে জ্ঞাত, তার বর্ণিত সমস্ত আহাদীস-ই প্রত্যাখ্যানযোগ্য।
[সূত্র: এবকারুল মতন, ১৯১ পৃষ্ঠা]
অতএব, হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) ও হযরত জাবের (رضي الله عنه) বর্ণিত উভয় হাদীসই বড় জোর দুর্বল (শেষোক্ত জনের বর্ণনাটি বানোয়াট বলে প্রমাণিত); অধিকন্তু, ইমাম আবূ দাউদ (رحمة الله عليه)-এর প্রদত্ত নিম্নের উসূলে হাদীসের ব্যাখ্যা অনুযায়ী হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه)-এর বর্ণিত হাদীসটি মকবূল বা গৃহীত বলে সাব্যস্ত হয়।
ইমাম আবূ দাউদ (رحمة الله عليه) একখানি হাদীস বর্ণনার পরে বলেন,
اذا تنازع الخبران عن النبي صلى الله عليه وسلم ينظر بما اخذ به اصحابه
অর্থাৎ, যদি মহানবী (ﷺ) হতে বর্ণিত দুটি হাদীসের মধ্যে ’পরস্পরবিরোধিতা’ দেখা যায়, তাহলে আমরা সেই রীতি গ্রহণ করি যেটি সাহাবা-এ-কেরাম কর্তৃক সমর্থিত।
[সূত্র: সুনানে আবি দাউদ, হাদীস নং ১৫৭৭-এর অধীন]
এমতাবস্থায় হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বর্ণিত হাদীসটি সমর্থিত হয়েছে, কেননা তা হযরত উমর (رضي الله عنه), হযরত উবাই বিন কাআব (رضي الله عنه) ও অন্যান্য আরও অনেকের বর্ণিত হাদীসের সাথে মিলে যায়।
ওহাবীরা অবশ্য ইমাম মালেক (رحمة الله عليه)-এর ‘মুওয়াত্তা’ হতে নিজেদের অবস্থানের পক্ষে আরেকটি রওয়ায়াত প্রদর্শন করে থাকে। কিন্তু এই বর্ণনাটি হযরত উবাই বিন কাআব (رضي الله عنه)-এর ২০ রাকআত তারাবীহ নামায পড়ানোর রীতি সম্পর্কে বর্ণিত একচেটিয়া আহাদীসের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ।
মুওয়াত্তা-এ-ইমাম মালেক, ৬ষ্ঠ বই, নম্বর ৬.২.৪
এয়াহইয়া আমার (ইমাম মালেক স্বয়ং) কাছে বর্ণনা করেন মালেক হতে, তিনি মুহাম্মদ ইবনে ইউসূফ হতে, এই মর্মে যে, হযরত সা’ইব ইবনে এয়াযীদ (رضي الله عنه) বলেন: “খলীফা হযরত উমর ফারূক (رضي الله عنه) হযরত উবাই ইবনে কাআব (رضي الله عنه) ও হযরত তামীম আদ্ দারী (رضي الله عنه)-কে নির্দেশ দেন যেন তাঁরা রাতের এগারো রাকআত নামাযের জামাআতে ইমামতি করেন। কুরআন তেলাওয়াতকারী (ইমাম) মি’ঈন (মধ্যম আকৃতির সূরার সমষ্টি) পাঠ করতেন, যতোক্ষণ না আমরা দীর্ঘ সময় নামাযে দণ্ডায়মান হওয়ার দরুন নিজেদের লাঠির ওপর ভর দিয়ে দাঁড়াতাম। ভোর না হওয়া পর্যন্ত আমরা (মসজিদ) ত্যাগ করতাম না।”
এটি-ই ‘সালাফী’দের কাছে দ্বিতীয় বড় দলিল।
পরিতাপের বিষয় এই যে, আল-জারহ ওয়াত্ তা’দীল এবং আসমাউর রেজাল জ্ঞানের শাস্ত্রগুলো সম্পর্কে অনবধান নিরীহ মুসলমান সর্বসাধারণকেই কেবল ‘সালাফী’রা ধোকা দিয়ে বিভ্রান্ত করতে পারে, কিন্তু আহলে সুন্নাতের জ্ঞান বিশারদগণ তাদেরকে এই জ্ঞানে সমুচিত শিক্ষা দেবেন।
’মুওয়াত্তা’ গ্রন্থে লক্ষণীয় যে এর এসনাদ হিসেবে বলা হয়েছে,
محمد بن يوسف عن السائب بن يزيد أنه قال أمر عمر بن الخطاب
অর্থাৎ, ‘মুহাম্মদ বিন ইউসূফ ‘আ’ন সাইব ইবনে এয়াযীদ’ (সাইব বিন এয়াযীদ হতে মুহাম্মদ বিন ইউসূফ বর্ণিত)।
লক্ষণীয় হচ্ছে "মুহাম্মাদ বিন ইউসুফ আন সাইব ইবনে ইয়াজিদ"
‘মোসান্নাফ-এ-আবদির রাযযাক’ গ্রন্থে ওই একই বর্ণনা একই এসনাদ-সহ লিপিবদ্ধ আছে, কিন্তু তাতে বিবৃত হয়েছে:
محمد بن يوسف عن السائب بن يزيد أن عمر جمع الناس في رمضان على أبي بن كعب وعلى تميم الداري على إحدى وعشرين ركعة
অর্থাৎ, হযরত সাইব বিন এয়াযীদ (رضي الله عنه) হতে মুহাম্মদ বিন ইউসূফ বর্ণনা করেন যে, খলীফা হযরত উমর ফারূক (رضي الله عنه) রমযান মাসে মানুষদেরকে হযরত উবাই ইবনে কাআব (رضي الله عنه) ও হযরত তামীম দারী (رضي الله عنه) -এর ইমামতিতে একুশ রাকআত নামায জামাতে আদায়ের নির্দেশ দেন।
[সূত্র: মুসান্নাফে আবদির রাযযাক, ৪র্থ খণ্ড, ২৬০ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ৭৭৩০]অতএব, ‘মুওয়াত্তা’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ বর্ণনা থেকেও ৮ রাকআত প্রমাণিত হয় না, বরং ওপরের রওয়ায়াত থেকে সুস্পষ্টভাবে ২০ রাকআত তারাবীহ’র নামায-ই প্রমাণিত হয়। এক্ষণে ‘সালাফী’দের কাছে খুলাফায়ে রাশেদীনের আর কোনো বর্ণনা নেই যা দ্বারা ৮ রাকআত তারাবীহ সাব্যস্ত করা যায়। কাজেই ’মুওয়াত্তা’ গ্রন্থে বর্ণিত রওয়ায়াতটি ‘মুদতারেব’ হিসেবে প্রমাণিত হয় এবং তাই এটি প্রামাণিক দলিল বলে গ্রহণের অযোগ্য। অনুগ্রহ করে ওপরে পেশকৃত বিভিন্ন রওয়ায়াতের একচেটিয়া দলিলগুলো দেখুন, যা’তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে হযরত উবাই ইবনে কাআব (রা:) ২০ রাকআত তারাবীহ আদায় করেছেন।
এমন কি ’সালাফী’গুরু (তাদের ‘শায়খুল ইসলাম’) ইবনে তাইমিয়াহ আল-মুজাসমী-ও এ সম্পর্কে বলে:
ثبت أن أبي بن كعب كان يقوم بالناس عشرين ركعة في قيام رمضان، ويوتر بثلاث. فرأي كثير من العلماء أن ذلك هو السنة؛ لأنه أقامه بين المهاجرين والأنصار، ولم ينكره منكر
অর্থাৎ, “এটি সপ্রমাণিত যে হযরত উবাই ইবনে কাআব (رضي الله عنه) রমযান মাসে সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-দের জামাআতে ২০ রাকআত তারাবীহ ও ৩ রাকআত বেতরের নামাযে ইমামতি করতেন। অতএব, অধিকাংশ উলামা-এ-কেরামের মাসলাক (রীতি-নীতি) এই যে, এটি-ই সুন্নাহ। কেননা, হযরত উবাই ইবনে কাআব (رضي الله عنه) এই ২০ রাকআতের ইমামতি করার সময় ওখানে উপস্থিত ছিলেন মোহাজির (হিজরতকারী) ও আনসার (সাহায্যকারী) সাহাবীবৃন্দ, কিন্তু তাঁদের একজনও এর বিরোধিতা করেন নি!”
[সূত্র: ইবনে তাইমিয়াহ কৃত মজমুয়া-এ-ফাতাওয়া, ১:১৯১]
দলিল-১১
حَدَّثَنَا أَبُو مُعَاوِيَةَ ، عَنْ حَجَّاجٍ ، عَنْ أَبِي إِسْحَاقَ ، عَنِ الْحَارِثِ أَنَّهُ كَانَ يَؤُمُّ النَّاسَ فِي رَمَضَانَ بِاللَّيْلِ بِعِشْرِينَ رَكْعَةً وَيُوتِرُ بِثَلاَثٍ وَيَقْنُتُ قَبْلَ الرُّكُوعِ
অর্থাৎ, আল-হারিস (রা:) বর্ণনা করেন যে তিনি রমযান মাসে ২০ রাকআত তারাবীহ নামায আদায় করতেন, আর ৩ রাকআত বেতরের নামাযেও ইমামতি করতেন এবং রুকূর আগে কুনূত পড়তেন।
[সূত্র: মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বাহ, ৫ম খণ্ড, ২২৪ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ৭৭৬৭]
দলিল-১২ এবং তারাবীহ’র সংজ্ঞা
حَدَّثَنَا غُنْدَرٌ ، عَنْ شُعْبَةَ ، عَنْ خَلَفٍ ، عَنْ رَبِيعٍ وَأَثْنَى عَلَيْهِ خَيْرًا ، عَنْ أَبِي الْبَخْتَرِيِّ أَنَّهُ كَانَ يُصَلِّي خَمْسَ تَرْوِيحَاتٍ فِي رَمَضَانَ وَيُوتِرُ بِثَلاَثٍ
অর্থাৎ, হযরত আবূ আল-বখতারী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত যে তিনি রমযান মাসে জামাআতে ‘৫ তারভিয়াত’ (অর্থাৎ, ২০ রাকআত তারাবীহ) নামাযের এবং ৩ রাকাত বেতরের নামাযের ইমামতি করতেন।
[সূত্র: মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বাহ, ৫ম খণ্ড, ২২৪ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ৭৭৬৮]
বি:দ্র: তারাবীহ নামাযে প্রতি ৪ রাকআতে এক ‘তারভিহ’ (বিশ্রামের সময়)। পাঁচ ’তারভিহাত’ হলো ৫ × ৪ = ২০ রাকআত।
দলিল-১৩
حَدَّثَنَا ابْنُ نُمَيْرٍ ، عَنْ عَبْدِ الْمَلِكِ ، عَنْ عَطَاءٍ ، قَالَ أَدْرَكْت النَّاسَ وَهُمْ يُصَلُّونَ ثَلاَثًا وَعِشْرِينَ رَكْعَةً بِالْوِتْرِ
অর্থাৎ, হযরত আতা’ ইবনে রুবাহ (رضي الله عنه) বলেন: আমি সব সময়-ই মানুষদেরকে ২৩ রাকআত (তারাবীহ) পড়তে দেখেছি, যা’তে অন্তর্ভুক্ত ছিল বেতরের নামায।
[সূত্র: মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বাহ, ৫ম খণ্ড, ২২৪ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ৭৭৭০]
দলিল-১৪
حَدَّثَنَا وَكِيعٌ ، عَنْ سُفْيَانَ ، عَنْ أَبِي إِسْحَاقَ ، عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ قَيْسٍ ، عَنْ شُتَيْرِ بْنِ شَكَلٍ أَنَّهُ كَانَ يُصَلِّي فِي رَمَضَانَ عِشْرِينَ رَكْعَةً وَالْوِتْرَ
অর্থাৎ, হযরত শায়তার ইবনে শাকী হতে প্রমাণিত যে তিনি রমযান মাসে ২০ রাকআত তারাবীহ নামাযের জামাআতে এবং বেতরের নামাযেও ইমামতি করতেন।
[সূত্র: মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, ৫ম খণ্ড, ২২২ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ৭৭৬২]
দলিল-১৫
الفضل بن دكين عن سعيد بن عبيد ان علي بن ربيعة كان يصلي بهم في رمضان خمس ترويحات ويوتر ثلاث.
অর্থাৎ, হযরত সাঈদ বিন উবাইদ বর্ণনা করেন যে হযরত আলী বিন রাবিয়াহ (رضي الله عنه) তাঁদেরকে ৫ তারভিহাত (২০ রাকআত তারাবীহ) নামাযে এবং ৩ রাকআত বেতরের নামাযেও ইমামতি করতেন।
[সূত্র: মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বাহ, ৫ম খণ্ড, ২২৪ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ৭৭৭২]
দলিল-১৬
وَالْمُخْتَارُ عِنْدَ أَبِي عَبْدِ اللَّهِ ، رَحِمَهُ اللَّهُ ، فِيهَا عِشْرُونَ رَكْعَةً . وَبِهَذَا قَالَ الثَّوْرِيُّ ، وَأَبُو حَنِيفَةَ ، وَالشَّافِعِيُّ . وَقَالَ مَالِكٌ : سِتَّةٌ وَثَلَاثُونَ . وَزَعَمَ أَنَّهُ الْأَمْرُ الْقَدِيمُ ، وَتَعَلَّقَ بِفِعْلِ أَهْلِ الْمَدِينَةِ ، فَإِنَّ صَالِحًا مَوْلَى التَّوْأَمَةِ قَالَ : أَدْرَكْتُ النَّاسَ يَقُومُونَ بِإِحْدَى وَأَرْبَعِينَ رَكْعَةً ، يُوتِرُونَ مِنْهَا بِخَمْسٍ . وَلَنَا ، أَنَّ عُمَرَ ،رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ لَمَّا جَمَعَ النَّاسَ عَلَى أُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ ، وَكَانَ يُصَلِّي لَهُمْ عِشْرِينَ رَكْعَةً ، وَقَدْ رَوَى الْحَسَنُ أَنَّ عُمَرَ جَمَعَ النَّاسَ عَلَى أُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ ، فَكَانَ يُصَلِّي لَهُمْ عِشْرِينَ لَيْلَةً ، وَلَا يَقْنُتُ بِهِمْ إلَّا فِي النِّصْفِ الثَّانِي فَإِذَا كَانَتْ الْعَشْرُ الْأَوَاخِرُ تَخَلَّفَ أُبَيٌّ ، فَصَلَّى فِي بَيْتِهِ ، فَكَانُوا يَقُولُونَ : أَبَقَ أُبَيٌّ رَوَاهُ أَبُو دَاوُد ، وَرَوَاهُ السَّائِبُ بْنُ يَزِيدَ ، وَرُوِيَ عَنْهُ مِنْ طُرُقٍ . وَرَوَى مَالِكٌ ، عَنْ يَزِيدَ بْنِ رُومَانَ ، قَالَ : كَانَ النَّاسُ يَقُومُونَ فِي زَمَنِ عُمَرَ فِي رَمَضَانَ بِثَلَاثٍ وَعِشْرِينَ رَكْعَةً . وَعَنْ عَلِيٍّ ، أَنَّهُ أَمَرَ رَجُلًا يُصَلِّي بِهِمْ فِي رَمَضَانَ عِشْرِينَ رَكْعَةً . وَهَذَا كَالْإِجْمَاعِ.
فاما ما رواه صالح ، فان صالحا ضعيف ، ثم لا ندرى من الناس الزين أخبر عنهم ؟ فلعله قد أدرك جماعة من الناس يفعلون زلك ، وليس زلك بحجة ، ثم لو ثبت أن أهل المدينة كلهم فعلوه لكان ما فعله عمر ، وأجمع عليه الصحابة فى عصره ، أولى بالاتباع ، قال بعض أهل العلم : إنما فعل هزا أهل المدينة لانهم أرادوا مساواة أهل مكة ، فان أهل مكة يطوفون سبعا بين كل ترويحتين ، فجعل أهل المدينة مكان كل سبع أربع ركعات ، وما كان عليه أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم أولى واحق أن يتبع .
অর্থাৎ, ইবনে কুদামাহ (رحمة الله عليه) ২০ রাকআত তারাবীহ নামাযের পক্ষে যে ‘এজমা’ হয়েছে, সে সম্পর্কে প্রমাণ পেশ করতে গিয়ে লিখেন:
আবূ আবদিল্লাহ (ইমাম আহমদ হাম্বল)-এর দৃষ্টিতে প্রতিষ্ঠিত দলিল হলো ২০ রাকআত (তারাবীহ); এ ব্যাপারে একই মত পোষণ করেন সর্ব-হযরত সুফিয়ান সাওরী (رحمة الله عليه), ইমাম আবূ হানিফা (رحمة الله عليه) ও ইমাম শাফেঈ (رحمة الله عليه)। ইমাম মালেক (رحمة الله عليه)-এর মতে এটি ৩৬ রাকআত। তিনি মদীনাবাসীর রীতি অনুসরণ করেন। কেননা, সালেহ বলেন তিনি সেখানকার মানুষকে দেখেছিলেন ৪১ রাকআত কেয়ামুল্ লাইল (তারাবীহ) পালন করতে, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল ৫ রাকআত বেতরের নামায। কিন্তু আমাদের প্রামাণ্য দলিল হচ্ছে খলীফা হযরত উমর ফারূক (رضي الله عنه)মানুষদেরকে সমবেত করে হযরত ইবনে কাআব (رضي الله عنه)-এর ইমামতিতে ২০ রাকআত তারাবীহ’র নামায জামাআতে আদায় করিয়েছেন। হযরত হাসসান (رضي الله عنه)-এর সূত্রে এ-ও বর্ণিত হয়েছে যে খলীফা হযরত উমর (رضي الله عنه) এভাবে ২০ রাত হযরত উবাই ইবনে কাআব (رضي الله عنه)-এর ইমামতিতে মানুষদেরকে জামাঅাতে নামায আদায় করিয়েছিলেন; আর তিনি (হযরত কাআব) রমযানের নিসফে (ওই সময়) শেষ দশ দিন তারাবীহ নিজের ঘরে পড়তেন। এই বর্ণনা ইমাম আবূ দাউদ (رحمة الله عليه) ও হযরত সাইব ইবনে এয়াযীদ (رضي الله عنه)-এর প্রদত্ত। ইমাম মালেক (رحمة الله عليه) এয়াযীদ ইবনে রুমান থেকে এ-ও বর্ণনা করেছেন যে, খলীফা হযরত উমর (رضي الله عنه)-এর শাসনামলে মানুষেরা ২৩ রাকআত তারাবীহ আদায় করতেন, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল ৩ রাকআত বিতর।
ইবনে কুদামাহ আরও লিখেন:
হযরত আলী(رضي الله عنه) হতে এ-ও বর্ণিত হয়েছে যে তিনি জনৈক ব্যক্তিকে ২০ রাকআত তারাবীহ’র জামাআতে ইমামতি করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। অতএব, ২০ রাকআত তারাবীহ’র ব্যাপারে এজমা’ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে। অধিকন্তু, সালেহ যে মদীনাবাসীদেরকে ৪১ রাকআত নামায পড়তে দেখেছিলেন, সে সম্পর্কে বলবো, সালেহ দুর্বল এবং আমরা জানি না ৪১ রাকআতের এই বর্ণনা কে দিয়েছিলেন। হতে পারে যে সালেহ কিছু মানুষকে ৪১ রাকআত পড়তে দেখেছিলেন, কিন্তু এটি তো হুজ্জাত (প্রামাণ্য দলিল) হতে পারে না। আমরা যদি ধরেও নেই যে মদীনাবাসী ৪১ রাকআত তারাবীহ (বেতরের ৫ রাকআত-সহ) পড়তেন, তবুও হযরত উমর (رضي الله عنه)-এর নির্দেশ, যা তাঁর সময়কার সকল সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه) অনুসরণ করেছিলেন, তা-ই অধিকতর অনুসরণযোগ্য। কয়েকজন উলেমা বলেন যে মদীনাবাসী মুসলমানগণ ৩৬ রাকআত তারাবীহ পড়তেন যাতে মক্কাবাসী মুসলমানদের সাথে তা মিলে যায়; কেননা, মক্কাবাসীরা প্রতি ৪ রাকআত পড়ার পর তাওয়াফ করতেন এবং এভাবে তাঁরা ৭ বার তাওয়াফ করতেন। মদীনাবাসী মুসলমানগণ ওই সময়ের মধ্যে (অর্থাৎ, এক-্এক তওয়াফে) ৪ রাকআত আদায় করে নিতেন (নওয়াফিল)। কিন্তু আমরা যেহেতু জানি যে সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه) ২০ রাকআত তারাবীহ পড়েছেন, সেহেতু আমাদের তা-ই মান্য করা আবশ্যক।
[সূত্র: ইবনে কুদামাহ প্রণীত আল-মুগনী, ২য় খণ্ড, ৬০৪ পৃষ্ঠা]
দলিল-১৭
অর্থাৎ, আল-গুনিয়াতুত্ তালেবীন গ্রন্থে লেখা আছে: তারাবীহ নামাযের অন্তর্ভুক্ত ২০ রাকআত। প্রতি দুই রাকআতে প্রত্যেকের উচিত বৈঠকে সালাম ফেরানো; ফলে এ নামায ৫ তারউইহাত-বিশিষ্ট, যার প্রতি ৪ রাকআতে একটি তারভি (অর্থাৎ, ৫ বার চার রাকআত =২০)।
[সূত্র: আল-গুনিয়াতুত্ তালেবীন, ২য় খণ্ড, ২৫ পৃষ্ঠা]
দলিল-১৮
عن ابي الخصيب قال كان سويد بن غفلة يؤمنا في رمضان عشرين ركعة
অর্থাৎ, ইমাম বোখারী (رحمة الله عليه) তাঁর ‘আল-কুনা’ পুস্তকে রওয়ায়াত করেন: হযরত আবূ আল-খুসাইব (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে হযরত সুওয়াইদ বিন গাফালাহ (رضي الله عنه) সব সময়-ই রমযান মাসে আমাদেরকে নিয়ে জামাআতে বিশ রাকআত তারাবীহ নামাযে ইমামতি করতেন।
[সূত্র: আল-কুনা, ২য় খণ্ড, হাদীস নং ২৩৪]
চার মযহাবের ঐকমত্য/ইজমা’
১/ - হানাফী মযহাব
ইমাম বদরুদ্দীন আঈনী (رحمة الله عليه) বলেন,
رواه البيهقي بإسناد صحيح عن السائب بن يزيد الصحابي قال كانوا يقومون على عهد عمر رضي الله تعالى عنه بعشرين ركعة وعلى عهد عثمان وعلي رضي الله تعالى عنهما مثله وفي المغني عن علي أنه أمر رجلا أن يصلي بهم في رمضان بعشرين ركعة قال وهذا كالإجماع
অর্থাৎ, ইমাম বায়হাকী (رحمة الله عليه) সহীহ সনদে সাহাবী হযরত সাইব ইবনে এয়াযীদ(رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: ”আমি খলীফা উমর ফারূক (رضي الله عنه)-এর শাসনামলে (মানুষদেরকে) ২০ রাকআত (তারাবীহ) নামাযে দাঁড়াতে দেখেছি; এটি খলীফা হযরত উসমান (رضي الله عنه) এবং খলীফা হযরত আলী (رضي الله عنه)-এর আমলেও দেখেছি।” আল-মুগনী (হাম্বলী ফেকাহ’র প্রসিদ্ধ কেতাব) গ্রন্থে হযরত আলী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে যে তিনি জনৈক ব্যক্তিকে রমযান মাসে ২০ রাকআত তারাবীহ নামাযের জামাআতে ইমামতি করার হুকুম দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে সামগ্রিক এজমা’ (ঐকমত্য) রয়েছে।[সূত্র: উমদাতুল কারী, ৭ম খণ্ড, ১৭৭ পৃষ্ঠা]
ইমাম ইবনে হুমাম বলেন, হযরত উমর ফারূক (رضي الله عنه) -এর খেলাফত আমলে সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه) ও তাবেঈনবৃন্দ যে ২০ রাকআত তারাবীহ পড়তেন তা শক্তিশালী প্রামাণিক দলিল দ্বারা সমর্থিত। হযরত এয়াযীদ ইবনে রুমান (رضي الله عنه) হতে সহীহ রওয়ায়াত আছে যে খলীফা হযরত উমর (رضي الله عنه) -এর শাসনামলে মুসলমানবৃন্দ ২০ রাকআত তারাবীহ নামায পড়তেন। ইমাম নববী (رحمة الله عليه) -ও এই বর্ণনাটির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।[সূত্র: আল-ফাতহুল ক্কাদীর, ১ম খণ্ড, ৪৭০ পৃষ্ঠা]
মোল্লা আলী কারী (رحمة الله عليه) বলেন,
أجمع الصحابة على أن التراويح عشرون ركعة
অর্থাৎ, তারাবীহ যে ২০ রাকআত, সে ব্যাপারে সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-এর এজমা’ আছে।[সূত্র: মিরকাত শরহে মিশকাত, ২য় খণ্ড, ২০২ পৃষ্ঠা, মাকতাবা আল-মিশকাত প্রকাশিত]
২/ - হাম্বলী মযহাব
ইমাম ইবনে কুদামাহ (رحمة الله عليه) লিখেন,
كان الناس يقومون في زمن عمر في رمضان بثلاث وعشرين ركعة وعن علي, أنه أمر رجلا يصلي بهم في رمضان عشرين ركعة وهذا كالإجماع
অর্থাৎ, খলীফা হযরত উমর ফারূক (رضي الله عنه)-এর শাসনামলে মানুষেরা ২৩ রাকআত (তারাবীহ) নামায পড়তেন (৩ রাকআত বেতর-সহ)। আর হযরত আলী (رضي الله عنه) সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে তিনি জনৈক ব্যক্তিকে ২০ রাকআত তারাবীহ পড়াবার নির্দেশ দিয়েছিলেন; আর এ ব্যাপারে এজমা’ প্রতিষ্ঠিত (وهذا كالإجماع)।[সূত্র: ইবনে কুদামাহ আল-হাম্বলী কৃত আল-মুগনী পুস্তক, ১ম খণ্ড, ৮০২ পৃষ্ঠা, তারাবীহ নামাযে রাকআত অধ্যায়]
বড় পীর শায়খ আবদুল কাদের জিলানী আল-হাম্বলী (رحمة الله عليه) লিখেন, তারাবীহ নামাযের অন্তর্ভুক্ত ২০ রাকআত। প্রতি দুই রাকআতে প্রত্যেকের উচিত বৈঠকে সালাম ফেরানো; ফলে এ নামায ৫ তারউইহাত-বিশিষ্ট, যার প্রতি ৪ রাকআতে একটি তারভি (অর্থাৎ, ৫ বার চার রাকআত =২০)।[সূত্র: আল-গুনিয়াতুত্ তালেবীন, ২য় খণ্ড, ২৫ পৃষ্ঠা]
৩/ - শাফেঈ মযহাব
ইমাম তিরমিযী (رحمة الله عليه) লিখেন,
و قال الشافعي وهكذا أدركت ببلدنا بمكة يصلون عشرين ركعة
অর্থাৎ, ইমাম শাফেঈ (رحمة الله عليه) বলেছেন: আমি মক্কাবাসীদের দেখেছি ২০ রাকআত (তারাবীহ) নামায আদায় করতে।[সূত্র: সুনান-এ-তিরমিযী]
ইমাম গাযযালী (رحمة الله عليه) বলেন,
التراويح وهي عشرون ركعةوكيفيتها مشهورة وهي سنة مؤكدة
অর্থাৎ, তারাবীহ নামাযে অন্তর্ভুক্ত ২০ রাকআত। এর পদ্ধতি সর্বজনবিদিত এবং এটি সুন্নাতে মোয়াক্কাদাহ।[সূত্র: এয়াহইয়া-এ-উলূম আল-দ্বীন, ১ম খণ্ড, ১৩৯ পৃষ্ঠা]
৪/ - মালেকী মযহাব
ইমাম ইবনে রুশদ্ আল-কুরতুবী (رحمة الله عليه) বলেন, ইমাম মালেক (رحمة الله عليه)-এর একটি কওল (বাণী) এবং ইমাম আবূ হানিফা (رحمة الله عليه), ইমাম শাফেঈ (رحمة الله عليه), ইমাম আহমদ হাম্বল(رحمة الله عليه) ও দাউদ আল-দাহিরীর কথা প্রমাণ করে যে তারাবীহ ২০ রাকআত। ইমাম মালেক (رحمة الله عليه) হযরত এয়াযীদ ইবনে রূমান (رضي الله عنه) থেকে এ-ও বর্ণনা করেছেন যে খলীফা হযরত উমর ফারূক (رضي الله عنه)-এর শাসনামলে মুসলমানগণ ২০ রাকআত (তারাবীহ) পড়তেন।
[সূত্র: ইবনে রুশদ্ প্রণীত আল-বেদায়াতুল মুজতাহিদ, ১ম খণ্ড, ১৫২ পৃষ্ঠা]
কিছু মানুষ যে ৩৬ রাকআত-সম্পর্কিত বর্ণনাটির অপব্যবহার করে, তা-ও ২০ রাকআত তারাবীহকে সপ্রমাণ করে। কেননা, ইমাম মালেক (رحمة الله عليه) প্রতি তারভিহ (৪ রাকআতের মাঝে বিশ্রামের সময়কাল)-তে ‘অতিরিক্ত ৪ রাকআত’ পড়ার জন্যে মানুষকে পরামর্শ দিতেন। তাই এটি তারাবীহ’র অংশ নয়। অতএব, তারাবীহ ২০ রাকআত হওয়ার ব্যাপারে সামগ্রিক এজমা’ হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ ৩৬ রাকআত তারাবীহ খুলাফা-এ-রাশেদীনের কারো কাছ থেকে প্রমাণিত নয়। সর্বোপরি, ইমাম মালেক (رحمة الله عليه)-এর মুওয়াত্তা গ্রন্থ হতে উদ্ধৃত উপরোক্ত দু’টি রওয়ায়াত (বর্ণনা) প্রমাণ করে তারাবীহ’র নামায ২০ রাকআত।
= সমাপ্ত =
ফেইসবুক বন্ধু মাহমূদ হাসানের নোট: পড়ুন; পৃথক ফোল্ডারে কপি করে রাখুন:
▆ তারাবিহ ২০ রাকাআত; ৮ রাকাআত নয়।
নোট ০১.
আলবানীদের আলবানী (১৯১৪-১৯৯৯খ্রিস্টিয়)-র অদ্ভূত ফতোয়া।
https://mbasic.facebook.com/hasan.ma…/posts/1761420850840019
নোট ০২.
https://mbasic.facebook.com/hasan.ma…/posts/1761424207506350
নোট ০৩.
https://mbasic.facebook.com/hasan.ma…/posts/1761426690839435
নোট ০৪.
সউদী শায়েখ সালিহ বিন ফাউযানের ফতোয়া : তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ এর মধ্যে পার্থক্য।
https://mbasic.facebook.com/hasan.ma…/posts/1761428907505880
▆ হাদিস সম্পর্কে জরুরী জ্ঞাতব্য বিষয়ঃ
নোট ০১. দ্বয়ীফ হাদিসের উপর 'আমল করা মুস্তাহাব
https://mobile.facebook.com/hasan.ma…/posts/1697298063918965
নোট ০২. জাল হাদিসের হুকুম
https://mobile.facebook.com/hasan.ma…/posts/1697295443919227
নোট ০৩. ``হাদিসটি সহিহ্ নয়`` বলতে মুহাদ্দিসিনে ক্বিরাম কি বুঝিয়ে থাকেন!
https://mobile.facebook.com/hasan.ma…/posts/1697290543919717
____
▆ মাসজিদুল হারামে তারাবিহ এর দু'টি জামাআত হয় না।
মাত্র 2.14MB ভিডও; সত্য উন্মোচন হয়ে গেলো........
উপমহাদেশীয় আ. রাজ্জাক শেখ, মোজাফ্ফর শেখ ও তাদের মুরিদ শায়খেরা কাজ্জাব।
প্রথমে তাদের মুখ থেকেই শুনুন।
অত:পর
শুনুন :
ডক্টর আব্দুল আজীজ আল-হাজ।
# মুসাইদুল ইমাম (সহকারী ইমাম) মসজিদুল হারাম;
# চেয়ারম্যানঃ হাদীস বিভাগ, মহাবিদ্যালয় মসজিদুল হারাম, মক্কা মুকাররামা।
এঁর সাক্ষাতকার।
যারা Youtube লিংক থেকে শুনতে চান তাদের জন্যে : https://www.youtube.com/watch?v=Us8S3zTmbaw
▆ প্রসঙ্গ : সহীহ্-যয়ীফ নির্ধারনে হাদিসের তাহকিক (Authentication) আসলে কী।
https://www.facebook.com/hasan.mahmud/posts/1688604351455003
No comments:
Post a Comment