Wednesday 31 October 2018

দীপ্ত সূর্যের গুপ্ত আলো 🖋 লিখেছেন - মেহেদী গালীব ( Mahdi Galib)

দীপ্ত সূর্যের গুপ্ত আলো  
🖋 লিখেছেন - মাহদী গালীব ( Mahdi Galib)


Image may contain: text


১ম পর্ব
আমরা দেখি কি দিয়ে? আলো দিয়ে। আলো যত উজ্জ্বল, দেখব তত বেশী। সবচে উজ্জ্বল কি? উত্তর, সূর্য। দুপুরের সূর্য। কিন্তু আমরা সূর্যকেই দেখতে পাই না। চোখে সয় না। মাধ্যম লাগে, চশমা লাগে। আজব না!
আজ এমনি সূর্যের কথা লিখব। একের পর এক। যাঁকে বুঝতে-দেখতেও মাধ্যম লাগে। এ মাধ্যমের নাম, বিবেক। যিনি সূর্যের মত প্রকাশিত। অবুও অদেখা। অযোগ্যতা আমাদের। তাঁকে পেয়েও পাই নি।
১৪ জুন ১৮৫৬। ২৮ অক্টোবর ১৯২১। ৬৫ বছর ৪ মাস, ১৫ দিন। ২৩,৮৭৭ : তেইশ হাজার আটশত সাতাত্তুর দিন।
গ্রন্থ সংখ্যা পনেরো শতাধিক। হিসেবের সুবিধায় ধরলাম দেড় হাজার। এবার 'দিন' এবং 'বই-সংখ্যা' ভাগ করি।
২৩,৮৭৭ ÷ ১,৫০০ = ১৫.৯১৮ (প্রায় ষোল দিন)।
থামুন। একটু ভুল হচ্ছে। আট বছরে তাঁর প্রথম বই। অতএব, আগের সাত বছর বাদ, ৬৫-৭। ফলাফল, ৫৭ বছর ৪ মাস ১৫ দিন । ২০,৮০৫ : বিশ হাজার আটশ পাঁচ দিন। লিপ ইয়ার ধরি নি। এবার ভাগ করি।
২০,৮০৫÷১,৫০০ = ১৩.৮৭ ( প্রায় চোদ্দ দিন) মানে চোদ্দ দিনে একটি বই লেখা হয়েছে।
আচ্ছা, দেড় হাজার বইয়ে মোট পাতা কত? তবে একদিনে কত পাতা লিখেছেন? ঘন্টায় কত? খোদার কসম জানি না। কল্পনাতেও আসে না।
ছোটতে রচনা পড়েছি। গরুর রচনা। 'কাউ ইজ আ ডোমেস্টিক এনিমেল'। আধ মাস যুঝেছি। মুখস্থ হয় নি। আর আধ মাসে একটা বই লেখা! মাসে দুইটা। থুক্কু! আটাশ দিনে।
সে বই কি রকম? না, 'আম পাতা জোড়া জোড়া' বই না। মহাকাশে কোটি নক্ষত্র। লক্ষ গ্রহ-উপগ্রহ। সব ছুটছে। প্রভাব রাখছে পৃথিবীতে। এইসব ছোটাছুটির হিসেব রাখে জ্যোতির্বিজ্ঞান। তিনি সেই আলোকবর্ষের হিসেব লিখেছেন।
সমাজবিজ্ঞান। আগে মানবিক বিভাগে ছিল। ক'বছর আগেই আলাদা হল। নতুন ফ্যাকাল্টি খুলল। অথচ তিনি শত বছর আগেই সমাজ বিজ্ঞানের ওপর লিখেছেন। জ্ঞানের স্বতন্ত্র শাখা হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
গণিতে দশের ওপর পাই নি। ম্যাট্রিকের টেস্টেও। একুব-বেকুবের সূত্র আজও বুঝি না। তিনি গণিতের সব শাখায় লিখেছেন। এমনকি প্রাইম নাম্বার নিয়েও। গণিত বিভাগের প্রধানও তাঁর থেকে সমাধান নিত।
আমি যাযাবর। জেলায়-থানায় ঘুরি। কত গাছ যে দেখি। প্রায় কিছুই চিনি না। বোটানির ছাত্রদের জিজ্ঞেস করি। তারাও জানে ন। অথচ তিনি গাছ-গাছরার ওপর বিশাল গ্রন্থ লিখে বসে আছেন। শত বছর আগেই। গাছ থেকে ওষুধ হয়। একে ভেষজবিদ্যা বলে। তিনি ভেষজবিদ্যাও লিখেছেন। 'হামদার্দ-বিশ্ববিদ্যালয়' তাঁর লেখার ওপর গবেষণা করেছে। স্বীকার করেছে তাঁর পাণ্ডিত্য।
ভাষা বড় অদ্ভুত। প্রতি তিন মাইলে ভাষা পালটায়। 'খাইছো' হয় 'খাইছুন'। একে বলে ধ্বনিতত্ব। তিনি এর ওপরেও লিখেছেন। তাঁর প্রথম বই আরবী ব্যাকরণে ওপর।
আমি কবিতা লিখি। কবিতার আইন আছে। অনুপ্রাস, অন্তমিল, স্বরবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত - আরো মেলা কিছু। অত জানি না, মানিও না। অত মানলে কবিতা লেখাই অসম্ভব। আমার অযোগ্যতা। আর তিনি এসব আইনের মাস্টার ছিলনে। এবং স্রষ্টাও ছিলনে। এ আইনকে বলে বালাগাত, অলংকরণশাস্ত্র।
সব কিছু ছাপিয়ে ছিল তাঁর ফতওয়া। আমাদের সমাজে 'ফতওয়া' শব্দটা ব্যাকডেটেড। খ্যাত-খ্যাত শুনায়। যদিও বিষয়টা বিপরীত। আম্মা বলেন, 'ভাল্লুকের হাতে কোদাল'। ভাল্লুকের হাত ছোট। কোদাল না ধরতে পারে। না কোপাতে পারে। হাস্যকর অবস্থা। ঠিক তেমনি মূর্খ (সম)কওমী সম্প্রদায় ফতওয়াকে বাজারে শব্দ বানিয়েছে।
ফতওয়া মানে আইন। মুফতি সাহেব ফতওয়া দেন। মুফতি মানে আইন নির্ধারক। আইন প্রণেতা না। এবার ভাবুন তো, সুপ্রিমকোর্টের জজ সাহেবের মর্যাদা। যেকোনো জজের মর্যাদা। তারা কি আমজনতা? আমাদের মত? আফসোসের বিষয়, ভাল্লুকের মতই এদেশে চামড়া-চান্দা তুলে খাওয়ারা বিষাক্ত ছত্রাকের মত মুফতি আর ফতওয়ার জন্ম দিচ্ছে।
তাঁর লিখা ফতওয়া গ্রন্থ 'ফওয়ায়ে রেজভিয়া'। মোট তিরিশ খণ্ড। প্রতি খণ্ড গড়ে ৭০০ পাতা। মোট একুশ হাজার পাতা। বিয়াল্লিশ হাজার পৃষ্ঠা। মানবজীবনের সব আছে এতে।
তাঁর ফতওয়া ছিল যুগান্তকারী। জেনে অবাক হবেন, আপনার মানিব্যাগে যে টাকার নোট, সেটা তাঁর বদৌলতেই পেয়েছেন। তাঁর বদৌলতেই এখনো ৯৯.৯০% মুসলিম উদার, মানবিক।
আল্লাহ বলেন : হে মানব জাতী, তোমরা বড়ই তাড়াহুড়ো। আমাদের ধৈর্য কম। তাই লেখা বাড়াচ্ছি না। আজকের সমাপীকা টানছি।
তিনি দুই ঘন্টা ঘুমাতেন। বাইশ ঘন্টা কাজ করতেন। বেশি সময় লেখালেখি। কিন্তু কিভাবে সম্ভব? তাঁরও সংসার ছিল। আয়-রোজগার ছিল। এত লিখতেন কিভাবে? মাসে দুইটা বই। যার জন্য আলাদা ছাপাখানাই দেয়া হয়েছিল।
তাঁকে সরাসরি প্রশ্ন করা হল : আ'লা হযরত! এত কিভাবে লিখেন? তিনি হাসলেন। স্নিগ্ধ তাবাসসুম। বললেন, কলম দিয়ে লেখা হয়। তাই বলে কলম কি লিখতে পারে? না, যিনি কলম ধরেন তিনি লেখেন। জেনে রাখো, আমি আহমাদ রেযা একটি কলম মাত্র। আর আমাকে ধরে যিনি লিখছেন, তিনি বাগদাদ ওয়ালা। তিনি আমার গাউসে পাক!


২য়পর্ব

অর্থনীতি, ইকোনোমিক্স। ভার্সিটির একটি সাবজেক্ট। অর্থনীতি ও মানুষ অবিচ্ছেদ্য। ফ্যাল কড়ি মাখ তেলের মত। কড়ি বা অর্থ নেই, তেলও নেই। ১৯৪০ থেকে অর্থনীতিকে একটি বিষয় বিবেচনা করা হল। এর আগে সভ্যতা জানতও না। অথচ, ১৯১২ সালে অর্থনীতির বই লিখেন ইমাম আ'লা হযরত। অর্থনীতিকে স্বতন্ত্র সংজ্ঞায়িত করেন। পশ্চিমাদেরও ২৮ বছর আগে। প্রবর্তন করেন যুগান্তকারী পলিসি।
অবশ্য, এডাম স্মিথ অনেক আগেই একটা বই লিখেন। 'ওয়েলথ অভ নেশন' নামে। সেটা মুক্তবাজার অর্থনীতির ওপর। যা খুলে দিয়েছিল পুঁজিবাদ ও সম্রাজ্যবাদীদের দরজা। মানুষের রক্তচোষা অধ্যায়। 'মুক্তবাজার অর্থনীতি', ফ্রিম্যাসন, 'নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার' এবং ইজরাইল একসূতোয় গাঁথা। যার ঘোরতর বিরোধী আ'লা হযরত। একমাত্রও বলা যায়। সে এক বিশাল অধ্যায়। আরেকদিন বলব।

আ'লা হযরত চারটি সূত্র উপস্থাপন করেন।

(i) সঞ্চয় বা সেভিংস।

(ii) ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রণয়ন।

(iii) মুসলিম-মুসলিম বাণিজ্য।
(iv) ইসলামী বিজ্ঞানের প্রয়োগ।


সঞ্চয় বা সেভিংস :
ধরুন একশ টাকা আছে। ৮৫ টাকা খরচ করলেন। বাকি ১৫ টাকা জমাবেন। যা ধীরে ধীরে বড় হবে। কিস্তির পর কিস্তিতে। এক সময় সে অর্থ আপনি বিনিয়োগ করবেন। আপনার আর্থিক অবস্থা বদলাবে। কথাটা খুব সাধারণ মনে হয়। কিন্তু শত বছর আগের কথা ভাবুন। মানুষ তো অর্থনীতিকেই চিনত না। সেভিংস তো দূর কি বাত। আজকের গরিব দেশগুলোর সঞ্চয় ৫-৮%। আর উন্নত দেশের ১৫% বা বেশি। তাহলে বুঝুন সঞ্চয় কিভাবে অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে।
১৯৩৬ সাল। ইংল্যাণ্ডের লর্ড জে. এম কায়নেয 'থিওরি ওভ সেভিংস এণ্ড ইনভেস্টমেন্ট' প্রকাশ করে। যা হুবহু আ'লা হযরতের থিওরি। এজন্য বৃটিশরা তাকে 'লর্ড' উপাধিও দেয়। সম্মানিত করে।
এবার ভাবুন। কার বিয়ে কে পরে মালা! কার আবিষ্কার কে পায় পুরষ্কার।
আরেকটা কথা, আ'লা হযরত নাকি বৃটিশদের দালাল! যদি তাই হয়, তবে বৃটিশরা আ'লা হযরত কে কেন পুরষ্কৃত করল না? কেন এমন অবিচার? আফসোস! শত্রুরা মুসলিমের জ্ঞান কাজে লাগায়। আর আমরা তাঁকে চিনলামও না এখনো (আল্লাহ ন্যায় বিচারক)।
ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রণয়ন :
সে যুগে ব্যাংক ছিল হাতেগোনা। এর সাথে সাধারণ মানুষের পরিচয় ছিল না। আ'লা হযরত মুসলিমদের ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে বলেন। প্রথম সূত্র ছিল সঞ্চয়। এখন ব্যাংক না থাকলে মানুষ জমাবে কোথায়? বলে রাখি, বর্তমান ব্যাংক আর আ'লা হযরত এর ব্যাংকের ব্যাপক তফাত। যা সুদহীন। শরীয়া সমৃদ্ধ। অনেকটা নিরাপদ সিন্দুকের মত। মানুষ জমাবে, ব্যাংকে বেতন দিবে অর্থ রক্ষার জন্য।
এই ব্যাংকি ব্যবস্থার কারণে মানুষ সঞ্চয়মুখি হবে। বাড়বে অর্থের প্রবৃদ্ধি। অল্প পরিসরে বুঝানো কষ্টকর। মালিক আমাদের অনুমানের শক্তি দিক।
মুসলিম-মুসলিম বাণিজ্য :
এখানে বলা হয়, একজন মুসলিম শুধু মাত্র মুসলিমের সাথেই ব্যবসা-বাণিজ্য করবে। এতে মুসলিমের অর্থ মুসলিমের কাছেই থাকবে।
এখন ভাবতে পারেন, আ'লা হযরত সংকীর্ণমনা। তিনি বাকিদের ঘৃণা করতেন।
থামুন! গভীরে যান, ডুব দিন। মুসলিমদের শোচনীয় অবস্থা তখন। উসমানীয়দের পতন হচ্ছে। ভারতে বৃটিশ লুটছে। ত্রাহি-ত্রাহি অবস্থা। প্রশ্নটা ছিল মুসলিমদের অস্তিত্বের। বেঁচে থাকার। একটা উদাহরণ দেই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ। ইউরোপে ভয়াবহ অবস্থা। মানুষ না খেয়ে মরে। তারা তখন 'ইউরোপীয় কমন মার্কেট' (E. M. C.) বানায়। ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো নিজেদের মধ্যেই ব্যবসা করত। বাকিদের সুযোগ ছিল না।
আজকে তাদের অবস্থা কোথায়? বিশ্বে সবচে উন্নত অঞ্চল। আফসোস! আ'লা হযরত এর থিওরি তারা ব্যবহার করে। আর আমরা তাঁকে ইংরেজপ্রেমী বানাই।
এছাড়াও আ'লা হযরত কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল, দেশ, রাষ্ট্রের কথা বলেন নি। সারাবিশ্বেই মুসলিম আছে। তাই তার থিওরি সারা বিশ্বেই প্রযোজ্য।
আর অমুসলিমদের সাথে ব্যবসা বন্ধ হলে মাদক ও অন্যান্য হারাম বস্তুও আসা বন্ধ হবে। সুরক্ষিত থাকবে মুসলিম উম্মাহ। কি চমৎকার পন্থা। 'ফেড্রিক লিস্ট' একজন প্রখ্যাত জার্মান অর্থনীতিবিদ। তিনিও আ'লা হযরত এঁর এই নীতিকে স্বীকার করেছেন।
ইসলামী বিজ্ঞানের প্রয়োগ:
এ পয়েন্টা ভিন্ন। ভাবছেন অর্থনীতির সাথে এসবের কি সম্পর্ক। এখানে আ'লা হযরত এঁর অনন্যতা। যেখানে আমাদের চিন্তা শেষ। সেখানে তাঁর শুরু।
আ'লা হযরত চাইছিল মুসলিমরা শিক্ষিত হোক। যাতে আমরা সভ্যতার সাথে এগুতে পারি। শিক্ষার অনগ্রসর আমাদের ডুবাচ্ছিল।
যাকগে, মূল কথা এটা না। আ'লা হযরত এঁর ব্যাখ্যা ভিন্ন। আ'লা হযরত চাইছিলেন, অর্থনীতি বিষয়টি যেন ইসলামের মৌলিক একটি শাখায় পরিণত হয়। ইসলামের জ্ঞান-বিজ্ঞান যেন এতে সর্বোচ্চ প্রভাব রাখে। ফলে মুসলিমরা হবে অর্থনৈতিক সচেতন।
আজ কষ্ট হয়। সভ্যতা আজ পশ্চিমাদের। তারা যাই বকে, আমরা শিখি। নিজের ইতিহাসও আমরা জানি না।
এই ইতিহাসের এক অদেখা অধ্যায়ের নাম আ'লা হযরত ইমাম আহমাদ রেযা খান। তিনি ডাকছেন দু'হাত বাড়িয়ে। বলছেন তাঁকে আবিষ্কার করতে।

হে নতুন দিনের নব সেনানী!

ওঠ!

ফিরিয়ে আনো এই ব্যথিত সত্তার প্রাপ্য অধিকার,
বেরেলি থেকে সে তোমায় ডাকে বারবার!

৩য়পর্ব

হাফেয কাযিম আলি খান। ইমাম আ'লা হযরত এঁর পূর্বপুরুষ। তিনি জায়গীর পেয়েছিলেন। পুরষ্কার হিসেবে। জমিদারী তো বুঝি আমরা। বৃটিশরা এ প্রথা চালু করে। তেমনি জায়গীর ছিল মোঘলদের সৃষ্টি। জায়গীর অবশ্য আকৃতিতে বড়। কয়েকটি জমিদারী নিয়ে একটি জায়গীর হবে।
আ'লা হযরত এঁর পূর্বপুরুষ সম্রাট আওরঙ্গজেবের সেনাবাহিতে ছিল। আর আওরঙ্গজেব মোঘলদের একমাত্র বাদশা। যাকে 'ওয়ালিয়াল্লাহ' বলা হত। পূণ্যবান শাসক।
আ'লা হযরত'দের জায়গীর ছিল 'বুদাউন' জেলার 'কারটাউলি' গ্রাম। বর্তমান বেরেলি শরীফ থেকে ৩৮ কি.মি. দূরে। পুরো গ্রামটাই তাঁদের ছিল ১৯৭৮ অবধি। চল্লিশ কি.মি. জুড়ে ছিল তাদের ভূ-সম্পদ। সৈয়দপুর থেকে দিনাজপুরের দূরত্ব। এক জেলা থেকে আরেক জেলা। সে যুগে ভারতের গ্রাম বলতে এটাই বুঝাত। ভাবা যায়, ৪০ কি.মি.!
যা-হোক, লেখার উদ্দেশ্য সম্পত্তি না। কিন্তু কি বিশাল সম্পত্তি তাই না। অবাক তথ্য কি জানেন? এত সম্পত্তির পরেও আ'লা হযরত এঁর ওপর যাকাত ফরয হয় নি। মানে যাকাত পরিমাণ সম্পদ কখনো ছিলই না। আজব না!
আ'লা হযরত এঁর ভাই-বোনদের মাঝে সম্পদ ভাগ হল। আ'লা হযরত ও পেলেন। এবং সেদিনেই তাঁর সমস্ত কিছু শ্রদ্ধেয়া মায়ের নামে লিখে দেন। নিজে একদম শূণ্য।
আ'লা হযরত কে কারণ জিজ্ঞেস করা হল। তিনি বললেন, আমি তো চালিয়ে নিব। যেমন করে হোক। কিন্তু আমার মা বিধবা। তিনি কি করবেন? তিনি যেন অসহায় বোধ না করেন। এবং কারো ওপর বোঝা না হন। তাই এমনটি করলাম। এছাড়া মায়ের সম্পদে তো সন্তানের অধিকার আছেই। কখনো লাগলে চেয়ে নিব।
এরপর শুধু বই কেনার জন্য তিনি মায়ের কাছে অর্থ নিতেন। এবং জানা যায় দান-খয়রাতের ক্ষেত্রে শাম্মে হুদা ইমাম জয়নুল আবেদিন আলাইহিস সালাম এঁর সুন্নাত অনুসরণ করতেন। গভীর রাতে অসহায়ের দরজায় অর্থ রাখতেন। এবং নিয়মিত রাখতেন।
এমনিতে তো ছিল না কিছুই। যা আসত বিলিয়ে দিত। যাকাত ফরয হয় কিভাবে!

'আরব্য উপন্যাস' লিখছি না। মহামানবদের জীবনী এমনি। মনে হয় কোনো মহাকব্যের অংশ।
যা-হোক, মূল কথায় আসি। একটা জিনিষ খেয়াল করেছেন? খুব সুক্ষ্ম। অনুমান করুন। আচ্ছা বলছি, বিষটি হচ্ছে 'নারী অধিকার'।
হ্যাঁ, নারী অধিকার। ১,৪০০ বছর আগে। মদিনায় সে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। মদিনা-মুনিব (দ) সর্বোপ্রথম বলেন, নারীর পদতলে জান্নাত। ইসলামই গর্তচাপা থেকে নারীকে উঠিয়েছে। শিশুকন্যার চিৎকারে তখন প্রকম্পিত হত খেজুরপাতা। লুন্ঠিত হত মানবতা। ইসলাম তা ঠেকিয়েছে। মদিনা-মুনিব (দ) দুধমায়ের জন্য নিজের পবিত্র রুমাল বিছালেন। সাহাবারা অবাক হয়েছেন। এত সম্মান একজন নারীকে!
আ'লা হযরর তো ভিন্ন কেউ নন। বিচ্ছিন্ন কেউ নন। তিনি তো মদিনা'র মাইলফলক। তাই তিনি আর মদিনা ভিন্ন হবে কেন!
- তোমার কাছে একশ টাকা আছে। এ টাকা বাবা-মায়ের জন্য। তবে পঁচিশ টাকা বাবাকে দাও। বাকি ৭৫ টাকা দাও মাকে।
- বাবা এবং মা একসাথে পানি চাইলো। আগে মাকে পানি দাও। এরপর বাবাকে।
- বাবা-মা সফর থেকে এসছেন। পা চিপতে চাও। সেবা করতে চাও। তবে জেনে রাখো, অধিকার আগে মায়ের।
কথাগুলো আ'লা হযরত এঁর। এরচে অনন্য অধিকার আর কি হতে পারে? এই নৈতিকতা, সম্মানবোধ হল একটি দরজা। যা বিকশিত করে মানুষের মননে নারীর সম্মান, মমত্ব, মর্যাদা।
ইমাম আ'লা হযরত এঁর পাঁচ সম্মানিত কন্যা ছিলেন। সকলেই যুগ শ্রেষ্ঠা, অনন্যা। আলেমা ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সর্বোচ্চ সনদ তাঁদের ছিল।
এ থেকে কি বুঝা যায়? ইমাম আ'লা হযরত নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে আপোস করেন নি। তিনি নিজের মেয়েদের পড়িয়েছেন। শরীয়ত সমৃদ্ধ করেছেন।
অথচ, ভারতেরই কেউ কেউ নারীশিক্ষাকে হারাম ফতওয়া দিয়েছিল। ইংরাজি শিক্ষাকে হারাম বলেছিল। এদের লক্ষ্য ছিল মুসলিমদের পিছিয়ে দেয়া { আল্লাহ ও তাঁর প্রেমাষ্পদ (দ) ভালো জানেন}।
একটু ভাবুন। ভাবুন আ'লা হযরত কে নিয়ে। জানুন, পড়ুন। কতটা ডাইনামিক ছিল এ মানুষটা। কতটা মানবিক ছিল। কতটা সৎ ও নির্লোভ ছিল।
তাঁকে গালি দিয়েন না প্লিজ। আমাকে বকেন। গালিবের আঠারো গোষ্ঠী উদ্ধার করেন। গালিব তো কিট তুল্য। মনে রাখবেন, আ'লা হযরত কে গালি দিলে, গালিটা লাগে মদিনা'র বুকে। সন্তানকে বকলে পিতাও আঘাত পান।
ইমাম আ'লা হযরর না থাকলে 'ওহাবী' চিনতাম না। ওহাবী শব্দটা তাঁর আবিষ্কার। ওহাবী না চিনলে মুসলিম থাকতাম কিনা খোদা মালুম। তিনি আমাদের বাঁচিয়েছেন। ইমান রক্ষা করেছেন। এ ঋণ কি অস্বীকার করতে পারবেন!
আল্লাহ আমাদের কৃতজ্ঞ করুক। কৃতজ্ঞ হবার ক্ষমতা দিক। যাতে আমরা ঋণবোধ করি আমাদের এহসানের ওপর। যে এহসান করেছেন, আমার হৃদয়ের বাদশা। সেই বেরেলির শাহেনশাহ, ইমাম আ'লা হযরত আহমাদ রেযা খান।

৪র্থ-পর্ব


পিএইচডি তো বুঝি। ধরুন প্রাতিষ্ঠানিক পড়া শেষ। মাস্টার্স বা স্নাতক করলেন। কিন্তু আরো জানতে চান। কিন্তু কি পড়বেন? এখানেই পিএইচডি। জ্ঞান-পিপাসা মেটানোর সন্ধান।
মাস্টার্স অবধি আপনি একাডেমি মুখি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যাই পড়াবে পড়তে হবে। আপনি বাধ্য। কিন্তু পিএইচডিতে আপনি স্বাধীন। একটি বিষয় পছন্দ করবেন। যা আপনার সাধ্যের মধ্যে। সাধ্য বলতে ক্ষমতা বুঝিয়েছি। দর্শনের কেউ নিশ্চই রসায়নে পারদর্শী নয়।
যা-হোক, সে বিষয়ে গবেষণা করবেন। নতুন কিছু আবিষ্কার করবেন। অভিসন্দর্ভ তৈরী করবেন। এই গবেষণায় আপনাকে একজন গাইড করবে। নির্দেশনা দিবে। যিনি আপনার সিনিয়র। আপনার থেকে ভালো বুঝেন। তাঁর নির্দেশনা ছাড়া চলা দুষ্কর। এরপর আপনার গবেষণা নিয়ে বোর্ড বসবে। তারা সিদ্ধান্ত নিবেন। আপনার কাজ সঠিক কিনা। সঠিক হলে আপনি ডক্টোর। সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী।
মূল কথায় আসি। প্রায়ই একটা কথা শুনি। ইসলাম ইজ দা ফুললি কোড অভ লাইফ। ইসলাম পরিপূর্ণ জীবনবিধান। এখন প্রশ্ন জীবন মানে কি? কখনো ভেবেছেন? বিশাল ফিলোসোফিলাক প্রশ্ন। আমার কাছে, জীবন মানে বিকাশ। বীজ অঙ্কুরিত না হলে কখনোই গাছ হবে না। গাছ না হলে ফুল-ফল-ছায়া আসবে না। এটাই বিকাশ।
একই ভাবে, মানুষ নিজেকে বিকশিত না করলে, সে পঁচনশীল বস্তু ছাড়া কিছুই না। বীজ যেমন পঁচে যায়। কেউ খোঁজও রাখে না।
এখন মানুষের বিকাশ কেমন? মানুষ জন্মায়। সমাজ তাঁকে শিক্ষিত করে। নৈতিকতা, মূল্যবোধ, মানবতা ইত্যাদি যোগান দেয়। চারা গাছে যেমন সার-পানি দেয়া হয়। এসব গুণ না থাকলে মানুষ শুধু পশু। পশু এবং মানুষ উভয়ে দেহধারী। উভয়ে পঁচনশীল।
সমাজের নৈতিকতা, মানবতা, মূল্যবোধ আসে কোত্থেকে? ধর্মদর্শন থেকে। মুসলিম সমাজে ইসলাম থেকে। ইসলাম সমাজকে স্কুল বানায়। স্কুলের আইন আছে। আইনের বাহিরে যাওয়া নিষিদ্ধ। ঠিক আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মত। এই আইনই হচ্ছে শরিয়া, শরিয়ত। শরিয়ত জীবনের সকল জায়গায় মানুষকে মানুষ হতে নার্সিং করে।
এখন প্রশ্ন, জীবন কয়টা? খাওয়া-ঘুমা-বেঁচে থাকাই কি জীবন? হালাল-হারামের পার্থক্যই কি জীবন? না, জীবন দুটো। ইহকাল এবং পরকাল। ইহকালের জীবনে তো শরীয়ত গাইড করে। কিন্তু পরকালে!
এ পরকাল বা অপার্থিব জীবনের জন্যই মারেফত। শরিয়ত আমাদের মানুষ বানায়। মাস্টার্স পাস করায়। আর পিএইচডি বা জ্ঞানের উন্মুখ রাজ্যে যাওয়ার দরজাই মারেফত।
মাস্টার্সের আগে স্বাধীনতা নেই। কারণ আপনি শিখছেন। সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা আপনার তখনো হয় নি। সিদ্ধান্তের ক্ষমতা এলেই স্বাধীন। কারণ শিশুর হাতে আগুন দিলে সে নিজেই পুড়বে। আর স্বাধীনতা তখনি আসে, মানুষ যখন স্রষ্টার সান্নিধ্য পায়। সীমাবদ্ধ সৃষ্টি থেকে অসীম স্রষ্টার স্বাদ পাওয়া। যা মানুষ সৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্য।
পিএইচডি করতে গাইড লাগে। মারেফাতে চলতেও গাইড লাগে। এই গাইড হচ্ছেন, মুর্শিদ বা পীর। অবশ্য পিএইচডি বিভিন্ন বিষয়ে হয়। মারেফাতের বিষয় একটি। স্রষ্টাকে পাওয়া। তাহলে মারেফাতে কি গবেষণা করা হয়? মারেফাতে গবেষণা করা হয় পথ, পন্থা, উপায়। কারণ একেক জনের জন্য পথ ভিন্ন। অসীম স্রষ্টা একেক ভাবে ধরা দেয় একেক জনের কাছে।
বলা হয়, সমস্ত মানুষ যত নি:স্বাস নিয়েছে, নিচ্ছে, নিবে - ঠিক তত সংখ্যক পথ আছে স্রষ্টাকে পাওয়ার।
মোটকথা, শরিয়ত মানুষকে পশু থেকে মুমিন বানায়। স্কুল যেমন মূর্খকে শিক্ষিত করে। আর মারেফাত মানুষকে জ্ঞান বা লক্ষ্যের চূড়ান্তে নিয়ে যায়।
ভার্সিটিতে ফ্যাকাল্টি থাকে। এক ফ্যাকাল্টিতে বহু বিষয়। বহু বিষয়ে অসংখ্য পিএইচডি। তেমনি মারেফাতেও ফ্যাকাল্টি বা অনুষদ থাকে। একে বলা হয় তরিকা (Sufi Order)। একটি তরিকায় ভর্তি হন। বায়াত গ্রহন করুন। একটি বিষয় নিন। গবেষণা করুন। নিজেকে জানুন। নিজের পথ চিনুন। স্রষ্টাকে চিনবেন। আপনার গবেষণা সঠিক হলে ডিগ্রি পাবেন। মারেফতে এ ডিগ্রির নাম খেলাফত।
এবার মূলেরও মূল কথা। একটি খেলাফত যথেষ্ট সত্যায়নের জন্য। কেউ যে স্রষ্টার সান্নিধ্য পেয়েছেন এটা তারই প্রমাণ। কিন্তু কেউ যদি একে একে তেরটা বা তারো বেশি খেলাফত পায়, তবে? তাহলে বুঝতে হবে স্রষ্টাকে সে ১৩ বার পেয়েছেন। তেরটা পিএইচডির মত। ভার্সিটির পিএইচডি না। অসীম স্রষ্টাকে পাওয়ার পিএইচডি।
ইমাম আ'লা হযরত একে একে ১৩ টি তরিকার খেলাফত প্রাপ্ত। তরিকাগুলো হচ্ছে :
1) কাদেরিয়া বারাকাতিয়া জাদীদাহ
2) কাদেরিয়া আবাইয়াহ কাদীমাহ
3) কাদেরিয়া আহদাইয়াহ
4) কাদেরিয়া রাজ্জাকিয়াহ
5) কাদেরিয়া মুনাওয়ারিয়াহ
6) চিশতিয়া নিযামিয়াহ
7) চিশতিয়া সাবরিয়াহ
8) নকশাবন্দি উলাইয়াহ (আবুল উলাইয়া)
9) নকশাবন্দি সিদ্দিকিয়া
10) সোহরাওয়ার্দিয়া কাদীমাহ
11) সোহরাওয়ার্দাহ জাঈদাহ
12) সিলসিলা এ বাদী'আহ
13) সিলসিলায়ে মানামিয়াহ
বেশির ভাগ তরিকায় আ'লা হযরত বায়াত ছিলেন না। কিন্তু সে তরিকতের মাশায়েখগণ উপহার স্বরুপ খেলাফত দিয়েছেন। কবি নজরুল ডক্টোরেট করেন নি। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে 'ডি. লিট' উপাধি দেয়। ডক্টোর অভ লিটারেচার। কারণ তার কর্ম সে যোগ্যতা রাখে।
একইভাবে আ'লা হযরত সব সিলসিলায় বায়াত হন নি। কিন্তু তাঁর কর্ম সব ছাপিয়ে গিয়েছিল। তাঁর যোগ্যতার কারণেই তাঁকে খেলাফত উপহার দেয়া হয়েছে।
শেষ কথা। ভাবুন তো, এই ১৩ জন মাশায়েখ কি মূর্খ ছিলেন। তাঁরা কি জানতেন না, আ'লা হযরত কুফরি করেছেন। কেউ কুফরি করলে আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছায় কিভাবে? আল্লাহ পর্যন্ত না পৌঁছালে খেলাফত পায় কিভাবে? তখন তো বাপের ছেলে, তাই খেলাফত এমন ছিল না।
জ্ঞানীদের জন্য ইশারাই যথেষ্ট।
মালিক আমাদের বুঝার শক্তি দিক। ধৈর্য দিক। হেদায়ত দিক। ধন্যবাদ।
৫ম-পর্ব

১৫০ বছর আগে। বিমান ছিলনা। না ছিল মোবাইল, টিভি। ইন্টারনেট কল্পনাতেও আসে নি। তখন তথ্য দ্রুত ছড়াতো না। বছরের পর বছর যেত। শতাব্দির পর শতাব্দী। ধীরে ধীরে প্রচার পেত।
কিন্তু ইমাম আ'লা হযরত তো ভিন্ন। তাঁর কর্মজীবন ৫৮ বছর। এ সময়েই তিনি বিশ্বে ছড়িয়েছেন। এ মাথা থেকে ও মাথা। শুধু পাক-ভারতে নয়। শতাব্দী থেকে শতাব্দী লাগে নি। আসুন দেখি কিভাবে।
দক্ষিণ আফ্রিকা। মহাসাগর পেরিয়ে ওপাড়ে। ভারতের বিপরীতে প্রায়। দূরত্ব, ৮,৮৭৩ কি.মি.। ৫,৩১৩ মাইল। ৪,৭৯১ ন্যাটিক্যাল মাইল। বর্তমানে বিমানে ৯ ঘন্টা ৫১ মিনিট লাগে। যদি বিমান ৯০০ কি.মি. প্রতি ঘন্টা উড়ে। তাও বিরতিহীন ভাবে। ১০০ কি.মি. গতিতে গাড়ি চালান। ৩ দিন ১৭ ঘন্টা লাগবে। একজন প্রশিক্ষিত, সুস্থ্য মানুষ দিনে ৩০ কি.মি. হাঁটতে পারে। সে গণিতে ২৯৬ দিনের হাঁটা পথ। ৯ মাস ২০ দিন প্রায়। এ সময়ে পুরো বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল।
যা-হোক, দক্ষিন আফ্রিকা থেকে ১১১ টি প্রশ্ন এসেছিল বারেলি শহরে। ভারতের উত্তর প্রদেশে। চিঠিতে ভরে। যা 'ফতোয়ায়ে আফ্রিকা' নামে পরিচিত। সেখানের মানুষ ইমাম আ'লা হযরতের কাছে সমাধান নিতেন। ফতোয়া নিতেন। ভাবা যায়!
পর্তুগাল চিনেন? আপনার আশপাশে না। ভূগোলের অন্যপ্রান্তে। বারেলি থেকে ৭,৮৭৮ কি.মি. প্রায়। বিমানে সোয়া আট ঘন্টা। রাস্তাপথে ৩ দিন ২০ ঘন্টা। হাঁটলে আট মাসের বেশি। ২৬২ দিন। তিনটি চিঠি এসেছিল। এবার ভাবুন, আ'লা হযরত এঁর পরিচিত কোথায় পৌঁছেছিল!
বার্মা বা মিয়াননার। ১,৮১১ কি.মি.। রাস্তাপথে ১০০ কি.মি. গতিতে ১৮ ঘন্টার বেশি। দু'মাসের বেশি হাঁটাপথে।
পাকিস্থান। ১,০০৩ কি.মি.। গাড়িতে ১০ ঘন্টার বেশি। লম্বা জার্নি করলে বুঝবেন। দশ ঘন্টা মানে কি। হাঁটলে ৩৪ দিন।
আফগানিস্তান। ১,২৭৬ কি.মি.। গাড়িতে ১৩ ঘন্টা। ৪২ দিন হাঁটলে।
বাগদাদ শরীদ, ইরাক। ৩,৩৮০ কি.মি. বিমানে সোয়া তিন ঘন্টা। রাস্তায় ৩৪ ঘন্টা। হাঁটাপথে ১১২ দিন। তিন মাস ২২ দিন।
মজার তথ্য কি জানেন? আমাদের বাংলাদেশ থেকেও চিঠি গিয়েছে। সমাধান চাওয়া হয়েছে। গুনেগুনে ৭৩ টি প্রশ্ন গিয়েছিল। বাংলা থেকে বারেলি কম দূরত্ব না। সরল রেখায় ১,২১০ কি.মি. ঘুরায় প্যাচায় না। টানা চিল্লা লাগবে হেঁটে পৌঁছালে। মানে চল্লিশ দিন।
একটা মানচিত্র আঁকুন। বারেলি শহর কে চিহ্নিত করুন। এরপর বাকি দেশগুলোতেও চিহ্ন দিন। কি দেখবেন জানেন? দেখবেন বারেলি মাঝখানে। চারদিক থেকে চিঠি আসছে। চিঠির সাথে আশা, প্রত্যাশা, স্বপ্ন। নিজের অজানাকে জানার তৃষ্ণা। একজন মানুষের কাছে পুরোবিশ্বের মানুষের জিজ্ঞাসা।
ঠিক যেমন মৌচাক। রাণী মৌমাছি মাঝে থাকে। তার চারদিকে গড়ে ওঠে সম্রাজ্য। ইমাম আ'লা হযরত এঁরও সম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল, উঠেছে। জ্ঞানের সম্রাজ্য। প্রজ্ঞার সম্রাজ্য। মদিনাপ্রেমের সম্রাজ্য।
আপনাকে স্বাগতম সে সম্রাজ্যে। প্রেমরাজ্যে।

Saturday 23 June 2018

বিষয়ঃ---তাকলীদ সম্পর্কে ওহাবী,লা মাযহাবী দের উত্থাপিত আপত্তি এবং উহাদের উত্তর?

বিষয়ঃ---তাকলীদ সম্পর্কে ওহাবী,লা মাযহাবী দের উত্থাপিত আপত্তি এবং উহাদের উত্তর

উপস্থাপনায়ঃ--সৈয়দ মোস্তাফা সাকিব

তাকলীদ সম্পর্কে উত্থাপিত আপত্তি এবং উহাদের উত্তর.....
তালীদের বিরােধীতাকারীদের উথাপিত আপত্তি সমূহ দু’ধরণের- কতগুলাে হচ্ছে অবান্তর, বাজে সমালােচনামূলক কিংবা বিদ্রুপাত্মক। এগুলাের উত্তরের প্রয়ােজন নেই। আর কতােগুলাে হচ্ছে প্রতারণামূলক প্রশ্ন উত্থাপন করে গায়র মুকাল্লিদগণ মাযহাবের অনুসারীগণকে ধোঁকা দিয়ে থাকে এবং সাধারণ মুকাল্লিদগণ তাদের প্রতারণার শিকার হয়ে পড়ে। এ শেষােক্ত প্রশ্নগুলাের উত্তরসহ নিম্নে বিস্তারিত বিবরণ পেশ করা হলাে।

১নং আপত্তিঃ----তাকলীদ যদি একান্ত প্রয়ােজন হতাে, তাহলে সাহাবায়ে কিরাম ( رضي الله عنه) কেন কারও তাকলীদ করেন নি? |

উত্তরঃ---সাহাবায়ে কিরাম ( رضي الله عنه) এর কারাে তাকলীদ করার প্রয়ােজন ছিল না। তাঁরা হযুর ﷺ সাহচর্য প্রাপ্ত হওয়ায় সমস্ত মুসলমানদের ধর্মীয় নেতা বা ইমাম হিসেবে গণ্য। ফলস্বরূপ ইমাম আবুহানীফা (رحمة الله عليه) , শাফিঈ (رحمة الله عليه)  প্রমুখ। ধর্মীয় ইমামগণ তাঁদেরই অনুসরণ করেছিলেন।

 মিশকাত শরীফের "ফাযাইলুস সাহাবা” অধ্যায়ে আছে:
أصحابي كالنجوم بأيهم اقتديتم اهتديتم
. (অথ্যাৎ আমার সাহাবীগণ তারকারাজির মত। তােমরা যে কারাে অনুসরণ করা না কেন, সঠিক পথের সন্ধান পাবে।)
উল্লেখিত হাদীছ গ্রন্থের একই অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ আছেঃ-
عليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين
. অর্থাৎ-তোমরা আমার ও আমার খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নতকে আকড়ে ধর।

উথাপিত আপত্তিটার দৃষ্টান্ত হলাে, যেমন কেউ বলতে পারে আমরা কারাে উম্মত নই। কেননা আমাদের নবী ﷺ কারাে উম্মত ছিলেন না। সুতরাং উম্মত না হওয়াটা রসুল ﷺর সুন্নত। এর উত্তরে বলতে হবে-হুজুর ﷺ.. নিজেই নবী, সবাই তাঁর উম্মত। অতএব, তিনি কার উম্মত হবেন?

 তদ্রুপ সাহাবায়ে কিরাম (رضي الله عنه) হলেন সবার ইমাম। সুতরাং তাঁদের ইমাম আবার কে হবে?


 ঐ শষ্য ক্ষেতেই নদী-নালা থেকে পানি সরবরাহ করা হয়, যার অবস্থান সাগর থেকে অনেক দুরে। মুকাবিরের তাকবীর শুনে ঐ সকল মুক্তাদীরাই নামায পড়েন, যারা ইমাম থেকে দুরে থাকেন। সাগর পাড়ের নিকটে অবস্থিত শষ্য ক্ষেতের জন্য নদী-নালার পানির প্রয়ােজন হয় না। আর প্রথম কাতারের মুক্তাদীগণের জন্য মুকাবিরের প্রয়ােজন পড়ে না। সাহাবায়ে কিরাম (رضي الله عنه) হচ্ছেন প্রথম কাতারের মুক্তাদী। তীরা কোন মাধ্যম ব্যতিরেকে সরাসরি হযুর ﷺ পবিত্র সিনা মুবারক থেকে ফয়েয প্রাপ্ত। আমরা যেহেতু ঐ সাগর (হযুরেরﷺ সিনা মুবারক) থেকে অনেক দুরে, সেহেতু আমাদেরকে খালের মুখাপেক্ষী হতে হয়। সাগর থেকে হাজার হাজার নদীর উৎপত্তি হয়, সে গুলােতে একই সাগরের পানি প্রবাহিত হয় বটে কিন্তু নাম ও গতিপথ ভিন্ন ভিন্ন। কোনটাকে গংগা, কোনটাকে যমুনা বলা হয়। অনুরূপ, হুযুর ﷺ হলেন রহমতের সাগর। তাঁর সিনা মুবারক থেকে যে নদী উৎপত্তি হয়ে ইমাম আবু হানীফা (رحمة الله عليه) এর পবিত্র বক্ষ মুবারক দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, উহাকে হানাফী নামকরণ করা হয়েছে, আর যেটি ইমাম মালিক (رحمة الله عليه) এর সিনা মুবারক দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, উহাকে মালিকী মাযহাব বলা হয়েছে। সব নদীর পানি এক ও অভিন্ন, কেবল নাম ভিন্ন ভিন্ন। ঐ সব নদীর পানির প্রয়ােজন হয়েছে আমাদের, সাহাবায়ে কিরামের (رضي الله عنه) নয়। যেমন হাদীছের সনদ বা সূত্রের প্রয়ােজনীয়তা অনুভুত হয় আমাদের নিকট সাহাবায়ে কিরাম (رضي الله عنه)এর নিকট উহার আদৌ প্রয়ােজন নেই।

২য় আপত্তিঃ---
 সঠিক পথের সন্ধানের জন্য কুরআন ও হাদীছই যথেষ্ট। কুরআন হাদীছে এমন কি বিষয় নেই, যার জন্য ফিকহের সাহায্য নিতে হবে? কুরআনেই ইরশাদ করা হয়েছেঃ
( وَلَا رَطْبٍ وَلَا يَابِسٍ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُبِينٍ)
[Surat Al-An'am 59]
(আদ্র বা শুষ্ক এমন কোন কিছু বাকী নেই, যা ঐশীনূরে আলােকিত কুরআনের মধ্যে লিপিবদ্ধ হয়নি) আরও বলা হয়েছে।
(وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُدَّكِرٍ)
[Surat Al-Qamar 17]
(আমি কুরআনকে শেখার বা স্মরণ রাখার বা মুখস্থ করার সুবিধার্থে সহজ করে দিয়েছি। স্মরণ করার কেউ আছে কি?)

এ আয়াত সমূহ থেকে বােঝা গেল, কুরআনের মধ্যে সব কিছু আছে এবং কুরআন প্রত্যেকের জন্য সহজ। তাই মুজতাহিদের নিকট যেতে হবে কি জন্য?

উত্তরঃ----
 হিদায়তের জন্য কুরআন ও হাদীছ নিঃসন্দেহে যথেষ্ট। এও ঠিক যে | কুরআন-হাদীছের মধ্যে সব কিছু আছে। কিন্তু এ থেকে মাসাইল বের করার উপযুক্ততা

থাকা চাই। সমুদ্রে অনেক মনিমুক্তা রয়েছে। এ গুলাে খুঁজে আনার জন্য ডুবুরীর প্রয়ােজন। ইমামগণ হলেন সমুদ্রের ডুবুরীর মত। চিকিৎসা শাস্ত্রের গ্রন্থাবলীতে সব | কিছুর উল্লেখ আছে; তবুও আমাদেরকে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয়, ব্যবস্থাপত্র নিতে হয়। ধর্মীয় ইমামগণই হলেন আমাদের ডাক্তার সদৃশ। আর কুরআনের আয়াত. (وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ)
[Surat Al-Qamar 17]
 এ বলা হয়েছে "কুরআনকে স্মরণ রাখার জন্য বা হিফজ করার জন্য সহজ করে দেয়া হয়েছে;"

 মাসাইল বের করার ক্ষেত্রে সহজ করে দেয়া হয়নি।
 যদি মাসাইল বের করা এতাে সহজ হয়, তাহলে হাদীছের কি প্রয়ােজন থাকতে পারে? কুরআনের সবকিছু আছে আর কুরআন সহজও। তবুও কুরআন শিক্ষা দেওয়ার জন্য নবী (দঃ) কেন এলেন? কুরআনেই আছে
 وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيهِم
[Surat Al-Baqarah 129]
(অর্থাৎ সেই নবী তাদেরকে আল্লাহর কালাম ও জ্ঞানবিজ্ঞান শিক্ষা দেন।)
 কুরআন ও হাদীছ হলাে রূহানী অষুধ, আর ইমাম হলেন রূহানী ডাক্তার।

৩য় আপত্তিঃ----- কুরআন শরীফে মাযহাবের অনুগামীদের নিন্দা করা হয়েছে। বলা হয়েছেঃ
(اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ
[Surat At-Tawbah 31]
(ওরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের পাদরী ও ঋষিদেরকে খােদা মেনে নিয়েছে) আরও বলা হয়েছেঃ
فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ
[Surat An-Nisa' 59]
যদি তােমাদের মধ্যে কোন বিষয়ে ঝগড়া-ঝাটি হয়, সেটার মীসাংসার জন্য আল্লাহ ও রসুল (আলাইহিস সালাম) এর শরণাপন্ন হও।।

আরও ইরশাদ করা হয়েছেঃ
وَأَنَّ هَٰذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ ۖ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ
[Surat Al-An'am 153]

(এটাই হলাে আমার সরল পথ। এ পথেই চলল। অন্যান্য পথে চলিও না, অন্যান্য পথে গেলে এ সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়বে।)

আরও ইরশাদ করা হয়েছেঃ
قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَا أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا
[Surat Al-Baqarah 170]
(তারা বলে-আমরাতাে ওই পথেই চলবাে, যে পথে আমাদের বাপ-দাদাদেরকে চলতে দেখেছি।)

এ সমস্ত আয়াত ও এ ধরণের অন্যান্য আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ ও রসুলের নির্দেশের সামনে ইমামগণের নির্দেশ অনুযায়ী চলা কাফিরদেরই অনুসৃত পন্থা। সহজ সরল পথ একটিই। শাফেঈ, হানাফী, ইত্যাদি পথ চতুষ্টয় হলাে বাঁকা পথ।

উত্তরঃ------ কুরআন করীম যে তাকলীদের নিন্দা করেছে, সেই সম্পর্কে আমি এ গ্রন্থের ১ম অধ্যায়ে আলােচনা করেছি। কুরআনের -
(وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ )
[Surat Al-An'am 153]
আয়াত (অন্যান্য পথে চলিও না) দ্বারা ইহুদীবাদ, খৃষ্টবাদ ইত্যাদি ইসলাম বিরােধী মতাদর্শকে বােঝানাে হয়েছে, আর হানাফী, শাফেঈ ইত্যাদি কয়েকটি পথ নয়, বরং একই ষ্টেশনগামী চারটি সড়ক বা একই নদী হতে উৎপন্ন চারটি খাল। তা না হলে গায়র মুকাল্লিদদের মধ্যে ছয়ী’ ও ‘গযনবী নামে যে দুটো দল রয়েছে, সে সম্পর্কে কি বলা হবে? ভিন্ন ভিন্ন পথের প্রশ্ন একমাত্র ‘আকাইদ বা বিশ্বাসের বিষয় বস্তু সমূহের পরিবর্তনের সহিত সম্পৃক্ত। চার মাযহাবের আকীদাহ এক। আমলের ক্ষেত্রে মতানৈক্যের ব্যাপারটিও গৌণ। এ ধরণের মতভেদ স্বয়ং সাহাবায়ে কিরামের মধ্যেও বিরাজমান ছিল।

Monday 28 May 2018

আপনি কি জানেন এক জন লুঠতরাজ কিভাবে হযরত ফুজাইল ইবনে আয়াজ রাদ্বি-আল্লাহু তায়ালা আনহু হয়ে গেলেন???

আপনি কি জানেন এক জন লুঠতরাজ কিভাবে হযরত ফুজাইল ইবনে আয়াজ রাদ্বি-আল্লাহু তায়ালা আনহু হয়ে গেলেন???
=================================

হযরত ফুজাইল ইবনে আয়াজ রাদিআল্লাহু আনহু | তাঁর নাম আবু আলী ফুজাইল ইবনে আয়াজ রাদিআল্লাহু আনহু . সমরকন্দে জন্মগ্রহণ করেন। জীবনের প্রারম্ভে মাঠে-প্রান্তরে লুটতরাজ করতেন । ১৮৭ হিজরি সনে মক্কায় ওফাত লাভ করেন। জীবনের সূচনাপর্বে এক ব্যক্তি এ আয়াতটি তেলাওয়াত করছিলেন:

 و ألم يأن للذين اموا أن تخشع قلوبهم لذكر الله في

" ঈমানদার জন্য কি এ সময় এখানাে আসেনি,তাদের অন্তর আল্লাহর যিকিরের ভয়ে ঝুঁকে যাবে?"

এ আয়াতটি তার অন্তরকে এভাবে প্রভাবিত করল, যেন কেউ বর্শা নিক্ষেপ করল । তিনি অনুতাপ-অনুশােচনা প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, এই লুটতরাজের খেলতামাশা আর কতদিন চলবে! এখন ঐ সময় এসে গেছে, আমরা যেন আল্লাহর রাস্তায় বের হয়ে পড়ি। একথা বলে অঝাের ধারায় কাঁদতে লাগলেন। এরপর হতে রিয়াজত-মুহাদায় একাগ্র হয়ে গেলেন।

কারাে মতে, তার তাওবার কারণ এটি যে, তিনি একটি মেয়েকে ভালােবাসতেন। একবার প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে তার কাছে যাচ্ছিলেন। (তখন) কানে কুরআন তেলাওয়াতের আওয়াজ আসল:

و ألم يأن للذين اموا أن تخشع قلوبهم لذكر الله في

‘"ঈমানদার জন্য কি এ সময় এখানাে আসেনি, তাদের অন্তর আল্লাহর যিকিরের ভয়ে ঝুকে যাবে?"

এর উত্তরে তিনি বললেন, হে আমার প্রভু! হ্যা, আমি এসে গেছি। সেখান থেকে ফিরে গিয়ে একটি বিজন প্রান্তরে রাত কাটালেন। সেখানে কিছু মুসাফির ছিল। তিনি তাদেরকে বললেন, এখান থেকে চলে যাও। তাদের মধ্য হতে কেউ কেউ বলল, এখানে সকাল পর্যন্ত থাকব। কারণ রাস্তায় ফুজাইল ইবনে আয়াজ থাকবে। সে লুটপাট করবে। তাদের কথার উত্তরে তিনি বললেন, সে তাওবা করেছে। অতঃপর তাদেরকে নিরাপত্তা দিলেন । তিনি আল্লাহ ও নবীর অনুসরণ এবং তাকওয়া ও ইবাদতের রাস্তা অবলম্বন করলেন। রিয়াজত-মুশাহাদায় বড় কামালিয়ত অর্জন করলেন।

হযরত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলতেন, আমি নিজ কানে হযরত ফুজাইলকে একথা বলতে শুনেছি যে, দুনিয়া অনুসন্ধানীরা অপমাণিত ও লাঞ্ছিত হয়। যখন আমি নিজের জন্য কিছু উপদেশের আরজ করলাম, তখন তিনি বললেন, খাদেম (সেবক) হও, মাখদুম (সেবা গ্রহণকারী) হয়ােনা। কেননা, খাদেম হওয়াই হচ্ছে সৌভাগ্যের কারণ । তিনি বলেন, যে ব্যক্তি যথাযথভাবে আল্লাহর পরিচয় লাভ করেছে, সে নিজের পুরাে শক্তি-সামর্থ মতে আল্লাহর ইবাদত করে। কেননা তার পরিচয় তার অনুগ্রহ ও করুণার পরিচয় দ্বারা অর্জন হয় । যখন ঐ ব্যক্তি তাঁর করুণার-অনুগ্রহের সাথে পরিচয় হয়ে যায়, তখন সে তাকে বন্ধু বানিয়ে নেয় আর যখন বন্ধু বানিয়ে নেয়, তখন পুরাে সামর্থ ও শক্তি অনুযায়ী তার আনুগত্য ও ইবাদত পালন করে। কেননা বন্ধুর কোন কাজ কঠিন নয়। এ ভিত্তিতে যে পরিমাণ বন্ধুত্ব বৃদ্ধি পাবে, সে পরিমাণ আনুগত্য ও ইবাদতের আকাক্সক্ষা বৃদ্ধি পাবে আর বন্ধুত্বের প্রাবল্য হচ্ছে মারিফাতের হাকীকত।

 জনৈক কারী সাহেব তার সামনে খুবই চমৎকার কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত করলেন। তখন তিনি বললেন, আমার বাচ্চাদের কাছে গিয়ে তেলাওয়াত করাে। কিন্তু সূরা আল-কারিয়া কখনাে পড়বেন না। কেননা, খােদাভীতির কারণে তারা কিয়ামতের আলােচনা শুনার শক্তি রাখেনা। কিন্তু কারী সাহেব সেখানে গিয়ে এ সূরাটি পড়লেন। তার সাহেবজাদা একটি চিৎকার দিলেন এবং দুনিয়া হতে বিদায় নিলেন।

কথিত আছে যে, তাকে ৩০ বছর পর্যন্ত কেউ হাসতে দেখেনি। কিন্তু যখন তার প্রিয় সন্তান ইহকাল হতে বিদায় নিল, তখন মুচকি হাসি দিলেন । লােকেরা যখন হাসির কারণ জিজ্ঞাসা করল, তিনি বললেন, আমি দেখেছি যে, আল্লাহ তা'আলা তার পরকালের দিকে যাত্রা দ্বারা সন্তুষ্ট হয়েছেন। সুতরাং আমিও তার সন্তুষ্টিতে খুশি হয়েছি।

ফুজাইল ইবনে রবি বর্ণনা করেন যে, আমি হারুনুর রশিদের সাথে মক্কা মুকাররমায় উপস্থিত ছিলাম। হজ্বের কাজ সমাধা করার পর তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এখানে কোন বুযর্গ ব্যক্তি আছে কিনা, যাতে তার সাক্ষাত লাভ করতে পারেন। (তৎকালীন যুগের লােকেরা মক্কা মুয়াজ্জমার মধ্যেও আহলুল্লাহদের অনুসন্ধানে থাকত।) আমি বললাম, হ্যা। সুতরাং আমি তাকে হযরত ফুজাইলের নিকট নিয়ে গেলাম। তখন তিনি নির্জনতায় বসেছিলেন। নিচে নেমে দরজা খুলে দয়ে প্রদীপ নিভিয়ে দিলেন এবং কক্ষে দণ্ডায়মান হয়ে গেলেন। হারুনুর রশিদ সরে চলে আসলেন। যখন হযরত ফুজাইলের হাত হারুনুর রশিদের হাত স্পর্শ করল, (ফুজাইল) তখন বললেন, ‘আফসােস! এরূপ তুলতুলে হাত আমি দেখিনি। এরূপ হাত যদি আল্লাহর আযাবে নিমজ্জিত হয়ে যায়, তাহলে খুবই তাজ্জবের পার। একথা শুনে হারুনুর রশিদের মধ্যে ভীতি ও বিনয়ভাব সৃষ্টি হল এবং তিনি এ পরিমাণ ক্রন্দন করলেন যে, তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন । যখন সংজ্ঞা ফিরে আসেন তখন বলতে লাগলেন, হে ফুজাইল! আমাকে কিছু উপদেশ দিন। হযরত ফজাই বললেন, হে আমিরুল মুমিনীন, তােমার পিতা ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আবেদন করলেন যে, আমাকে নিজ সম্প্রদায়ের আমির বানিয়ে দিন । রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে চাচা! আমি তোমাকে তােমার প্রাণের আমির বানিয়ে দিয়েছি। কেননা, তােমার একটি মুহূর্ত আল্লাহর আনুগত্যে কাটিয়ে দেয়া এ বিষয়টি হতে উত্তম যে, লােকেরা হাজার বছরধরে তােমার আনুগত্য করবে। কেননা, কিয়ামতের দিন বাদশাহী ও আমিরী শুধু দুঃখ ও লজ্জা ছাড়া আর কিছু পাবেনা। অতঃপর হযরত ফুজাইল বললেন, হে আমিরুল মুমিনীন! কখনাে যেন এরকম না হয় যে, তােমার এই সুন্দর চেহারাটি দোযখের আগুনে পাকড়াও হয়ে যায়। অন্তরে আল্লাহর ভয় রাখে এবং তারই হক উত্তম পন্থায় আদায় করাে। এরপর হারুনুর রশিদ বললেন, আপনার ওপর কিছু ঋণের বােঝা রয়েছে। তিনি বললেন, হ্যা, আল্লাহর ঋণ আমার গর্দানের ওপর রয়েছে আর তা হচ্ছে তার আনুগত্য আর যদি তিনি এর জন্য আমাকে পাকড়াও করেন, তাহলে তা হবে আমার জন্য দুর্ভাগ্য।

তিনি বলেন, মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত বিভিন্ন মানুষের সাথে বন্ধুত্ব রাখে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে লৌকিকতা হতে বাঁচতে পারেনা। আমরা এরূপ মানুষও দেখেছি, যে স্বীয় আমলে লৌকিকতা প্রদর্শন করে। কিন্তু এখন এরূপ মানুষও দেখা যাচ্ছে, যারা ঐ সব আমলের ব্যাপারে অহংকার করে, যা তারা করেও না। তিনি বলেন, আমি যখন দুনিয়াকে কারাে সাথে খেলা করতে দেখি, তখন আমার কান্না এসে যায়। যদি কুরআন-হাদীসের ধারক-বাহকরা দুনিয়া বিমুখতার ওপর ধৈর্য ধারণ করে, তাহলে মানুষেরা তাকে অপমানিত মনে করেনা। কিন্তু আফসােস একথার ওপর যে, যখন কেউ বলে, অমুখ আলেম বা অমুখ আবেদ অমুখ ব্যবসায়ীর খরচে হজ্বে গেছেন । তিনি বলেন, যদি তােমরা কোন আলেম বা আবেদকে দেখ যে, তারা রাজাবাদশা বা দুনিয়াদারের নিকট নিজেদের প্রশংসা শুনে সন্তুষ্ট হয়ে যায়, তাহলে বুঝে নাও যে, সে রিয়াকারী আর রিয়াকারীর একটি আলামত হচ্ছে যে, তার ইলম হবে। তাে পাহাড়সম, কিন্তু আমল হবে ধূলিকণাসম ।।

হযরত মালেক ইবনে দিনার রাদিআল্লাহু আনহু ও দুনিয়াবি স্বার্থের জন্য ইবাদত,ও উপদেশ।
[[আমাদের জন্য নমুনাস্বরূপ যা থেকে শিক্ষা নিতে হবে]]
================================

হযরত মালেক ইবনে দিনারের তাওবার সূচনা এভাবে যে, একরাত তিন একটি গানের দলে গান বাজনার মাহফিলে উন্মত্ত ছিলেন। যখন সকলে ঘুমিয়ে পড়লেন, তখন বেহালা হতে এ আওয়াজ বের হল, ?

يا مالك مالك الابتوب
 (হে মালেক তােমার কি হল, কতক্ষণ পর্যন্ত তাওবা না করে থাকবো?)
তখন তিনি পপিকার্য হতে বেরিয়ে আসলেন এবং ইমাম হাসান বসরীর দরবারে গিয়ে তাওবা করে নিজের অবস্থা সংশােধন করে নিলেন।

হযরত মালেক ইবনে দিনার দামেস্কে হযরত আমিরে মুয়াবিয়া রাদিআল্লাহু আনহু কর্তৃক নির্মিত মসজিদে ই'তিকাফ নিতেন। একদিন তার মনে আসল যে, এমন কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে যাক, এর দ্বারা আমাকে এই মসজিদের মুতাওয়ালি বানিয়ে দেয়া হয়। সুতরাং তিনি ইতিকাফ নিলেন এবং সারা বছর এত অধিক পরিমাণ নামাজ পড়লেন যে, লােকেরা তাকে সর্বদা নামাজে ব্যস্ত দেখতেন । কিন্তু কেউ তার প্রতি মনােযােগ দিল না। একবছর পর যখন তিনি মসজিদ হতে বিদায় নিলেন, তখন গায়েব হতে আওয়াজ আসল, হে মালেক! এখন তোমাকে নিজ স্বার্থপরতা হতে তাওবা করতে হবে। সুতরাং একবছর পর্যন্ত নিজ স্বার্থপরতামূলক ইবাদতের ওপর খুবই দুঃখিত ও লজ্জিত হলেন । তিনি নিজ আত্মাকে লৌকিকতা ও স্বার্থ হতে মুক্ত করে একনিষ্ঠ নিয়তে একরাতে ইবাদত করলেন। সকালে দেখতে পেলেন যে, মসজিদের সামনে মানুষের একটি সমাবেশ হয়েছে, যারা পরস্পর বলাবলি করছে যে, মসজিদের ব্যবস্থাপনার কাজ ঠিক নেই। সুতরাং ঐ ব্যক্তিকে (মালেক) মসজিদের মুতাওয়াল্লি বানিয়ে দেয়া হোক। এই সিদ্ধান্তে সকলে ঐক্যমত হয়ে যখন তার নিকট গেল এবং সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তাকে অবগত করল, তখন তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন, হে আল্লাহ! আমি একবছর পর্যন্ত লৌকিকতাপূর্ণ ইবাদতে এজন্যই নিমজ্জিত ছিলাম যে, মসজিদ পরিচালনার দায়িত্ব যেন আমার হাতে এসে যায়, কিন্তু তা পূর্ণ হয়নি। বর্তমানে যখন আমি সত্যদিলে তোমার ইবাদতে ব্যস্ত হয়েছি, তখন তোমার নির্দেশে সমস্ত লােকেরা আমাকে মুতাওয়ালি বানানোর জন্য এসেছে এবং কাঁধে এ দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়ার ইচ্ছা করছে । কিন্তু তােমার মাহাত্মের শপথ করছি যে, আমি এখন না তাে মুতওয়ালির দায়িত্ব গ্রহণ করব, আর না মসজিদ থেকে বের হব। একথা বলে আবার ইবাদতে বিভাের হয়ে গেলেন।

খােদাভীতির এ অবস্থা ছিল যে, তিনি যখন ::
إياك نعبد وإياك نستعين
আয়াতটি নামাজে পড়তেন, তখন ব্যাকুল হয়ে ক্রন্দন করতেন এবং বলতেন যে, এটি যদি কুরআনের আয়াত না হত, তাহলে আমি তা কখনাে পড়তাম না। কেননা, এর অর্থ এটি যে, হে আল্লাহ, আমরা তােমারই ইবাদত করি এবং তােমার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি। অথচ আমরা তাে শুধু প্রবৃত্তির পূজারী এবং মানুষের নিকট হতে সাহায্যের প্রত্যাশী। তিনি বলেন, যার দ্বারা কিয়ামতের দিন কোন উপকার হবেনা, তার সাহচর্য দ্বারা কি লাভ। তিনি জনৈক ব্যক্তিকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, আলাহর প্রদত্ত তাকদীরের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে যাও, যাতে তুমি হাশরের আযাব হতে মুক্তি পেতে পার।






Friday 25 May 2018

হযরত খাজা বাহা উদ্দিন নকশবন্দী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি কে ছিলেন??উপস্থাপনায় সৈয়দ মোস্তাফা সাকিব

হযরত খাজা বাহা উদ্দিন নকশবন্দী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি কে ছিলেন??
উপস্থাপনায় :-----সৈয়দ মোস্তাফা সাকিব.


সুফি:---সম্পাদনা

সুফি শব্দটির দুইটি ব্যুৎপত্তি পাওয়া যায়। সাধারণভাবে, শব্দটির আভিধানিক অর্থ ṣafā (صفاء)এর থেকে এসেছে, যার আরবি অর্থ বিশুদ্ধতা বা পবিত্রতা বা শুদ্ধতা বা পাপশূণ্যতা । আরেকটি আরবি মূল পাওয়া যায়, যা পশমṣūf (صُوف), শব্দটি থেকে সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারনা করা হয়ে থাকে। পশম ছিল তৎকালীন মুসলিম তাপসদের সাধারণ পোশাক। সুফি আল-রুধাবারি এই দুইটি মূলকে একত্রিত করেছেন যিনি বলেন, "সুফি হলেন সে ব্যক্তি যিনি চরম পবিত্রতার বস্ত্র (পশমী) পরিধান করেন।" মুসলিম পন্ডিতরা একমত হয়েছেন যে, "সুফ" (ṣūf) বা পশমহল "সুফি" শব্দটির সম্ভাব্য মূল।

ইসলামী শাখা হিসেবে:---সম্পাদনা

সুফিবাদ হচ্ছে ইসলামের আধ্যাত্বিক-তাপসদের মরমীবাদ। এটি কোন সম্প্রদায় নয়,কোন আলাদা পথ না  বরঞ্চ এটিকে মুল ইসলামিক ধারাবাহিক  শিক্ষা যা নবী পাক সাল্লালাহুতায়ালা আলাইহি ওসাল্লাম থেকে সাহাবা, সাহাবা থেকে তাবেঈন, তাবে তাবেঈন, তার থেকে আইমায়ে মুজতাহিদ মাধ্যমে আমাদের কাছে এসেছে, এখানে মুল বিবেচনা করা হয় যা মানুষের স্বীয় অভ্যন্তরীণ পরিশুদ্ধতার সাথে সম্পর্কযুক্ত।মানুষের অন্তর কে পরিশুদ্ধ করে ইমানী জজ্ববা তৈরি করার ইসলামের আদি পদ্ধতি কে সুফী য়ানে কেরাম গন আজকে বহনকারী, ইনশাআল্লাহ এই পদ্ধতি কেয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে।।

সুফিবাদঃ--

সুফিবাদ (সুফিবাদ বা সুফি দর্শন, আরবি- সুফিয়াত বা তাসাউফ) একটি ইসলামি আধ্যাত্মিক দর্শন। আত্মা সম্পর্কিত আলোচনা এর মুখ্য বিষয়। সুফিবাদের একমাত্র মূল বিষয়টি হল, আপন নফসের সঙ্গে, নিজ প্রাণের সাথে, নিজের জীবাত্মার সাথে পরমাত্মা আল্লাহ যে শয়তানটিকে আমাদের পরীক্ষা করার জন্য দেওয়া হয়েছে তার সাথে জিহাদ করে তার থেকে মুক্ত হয়ে এ জড় জগত থেকে মুক্তি পাওয়া। আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনই হল এই দর্শনের মর্মকথা। পরম সত্তা মহান আল্লাহ কে জানার এবং আকাঙ্ক্ষা মানুষেরচিরন্তন। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ককে আধ্যাত্মিক ধ্যান ও জ্ঞানের মাধ্যামে জানার প্রচেষ্টাকে সুফি দর্শন বা সুফিবাদ বলা হয়।
হযরত ইমাম গাজ্জালি (রহমাতুল্লাহ আলাইহির) এর মতে,
আল্লাহর ব্যতীত অপর মন্দ সবকিছু থেকে আত্মাকে প্রবিত্র করে সর্বদা আল্লাহর আরাধনায় নিমজ্জিত থাকা এবং সম্পূর্ণ রূপে আল্লাহুতে নিমগ্ন হওয়ার নামই সুফিবাদ বলে।

‘সুফ অর্থ পশম আর তাসাওউফের অর্থ পশমী বস্ত্রে পরিধানের অভ্যাস (লাব্‌সু’স-সুফ) - অতঃপর মরমীতত্ত্বের সাধনায় কারও জীবনকে নিয়োজিত করার কাজকে বলা হয় তাসাওউফ। যিনি নিজেকে এইরূপ সাধনায় সমর্পিত করেন ইসলামের পরিভাষায় তিনি সুফি নামে অভিহিত হন।’ 

 ইসলামি পরিভাষায় সুফিবাদকে তাসাওউফ বলা হয়, যার অর্থ আধ্যাত্মিক তত্ত্বজ্ঞান। তাসাওউফ বা সুফিবাদ বলতে অবিনশ্বর আত্মার পরিশুদ্ধির সাধনাকে বুঝায়। আত্মার পবিত্রতার মাধ্যমে ফানাফিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে অবস্থান করা) এবং ফানাফিল্লাহর মাধ্যমে বাকাবিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে স্থায়িভাবে বিলীন হয়ে যাওয়া) লাভ করা যায়। যেহেতু আল্লাহ নিরাকার, তাই তাঁর মধ্যে ফানা হওয়ার জন্য নিরাকার শক্তির প্রতি প্রেমই একমাত্র মাধ্যম। তাসাওউফ দর্শন অনুযায়ী এই সাধনাকে ‘ তরিকত ’ বা আল্লাহ-প্রাপ্তির পথ বলা হয়। তরিকত সাধনায় মুর্শিদ বা পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন হয়। সেই পথ হলো ফানা ফিশ্‌শাইখ, ফানা ফিররাসুল ও ফানাফিল্লাহ। ফানাফিল্লাহ হওয়ার পর বাকাবিল্লাহ লাভ হয়। বাকাবিল্লাহ অর্জিত হলে সুফি দর্শন অনুযায়ী সুফি আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ শক্তিতে শক্তিমান হন। তখন সুফির অন্তরে সার্বক্ষণিক শান্তি ও আনন্দ বিরাজ করে।
সুফিগণের মতে, হযরত মুহাম্মাদ (সাল্লাহুতায়ালা আলাইহি ওসাল্লাম)স্বয়ং সুফিদর্শনের প্রবর্তক।
হুজুর সাল্লালাহুতায়ালা আলাইহি ওসাল্লাম এর আদ্ধাত্মীক জ্ঞানের দ্বারা সাহাবায়ে কেরম নিজের কে দুনিয়াতে তুলে ধরেছেন।।

সাহাবায়ে কেরাম থেকে সেই শিক্ষা তাবেঈন, ক্রমে তাবে তাবেঈন, আইমায়ে মুজতাহিদ থেকে বর্তমানে ক্রম বর্তমান।
এর সপক্ষে  নুর নবী (সাল্লাহুতায়ালা আলাইহি ওসাল্লাম) এর একটি হাদিস উল্লেখ হল.....

মানবদেহে একটি বিশেষ অঙ্গ আছে, যা সুস্থ থাকলে সমগ্র দেহ পরিশুদ্ধ থাকে, আর অসুস্থ থাকলে সমগ্র দেহ অপরিশুদ্ধ হয়ে যায়। জেনে রাখো এটি হলো কল্‌ব বা হৃদয়। 

বিঃদ্রঃ--- এছাড়াও বহু নমুনা পাওয়া যায় হাদীসের কিতাব থেকে যার দ্বারা হুজুর সাল্লালাহুতায়ালা আলাইহি ওসাল্লাম সাহাবায়ে কেরাম কে তাসাউফ শিক্ষা দিয়ে ছেন সেই শিক্ষার দ্বারা সাহাবায়ে কেয়াম এক এক জন দর্শনের সেই স্থানে পৌছে গিয়েছিলেন যার জন্য হুজুর সাল্লালাহু তায়ালা আলালাইহি ওসাল্লাম আবারো ইরশাদ করেন.......

আমার সাহাবায়ে কেরাম হলেন আকাশের উজ্জ্বলিত তারোকা,আর আমার আহালে বাইয়াত হল নুহ আলাইহিসালাম এর সাফিনা(নৌকা),।।

আমাদের নমুনা সাহাবা, ও আহলে বাইয়াত কে অনুযায়ী নিজের আধ্যাত্মিক জ্ঞান কে প্রসারিত করতে থাকলে ইনশাআল্লাহ উম্মতে মোহাম্মাদ কোনো দিন পথভ্রষ্ট হবেনা ইনশাআল্লাহ।।

আল্লাহর জিকর বা স্মরণে কল্‌ব কলুষমুক্ত হয়। সার্বক্ষণিক আল্লাহরস্মরণের মাধ্যমে কল্‌বকে কলুষমুক্ত করে আল্লাহর প্রেমার্জন সুফিবাদের উদ্দেশ্য। যাঁরা তাঁর প্রেমার্জন করেছেন, তাঁদের তরিকা বা পথ অনুসরণ করে ফানাফিল্লাহর মাধ্যমে বাকাবিল্লাহ অর্জন করাই হলো সুফিদর্শন।


যারা সেই প্রেমাজন করতে সক্ষম তাদের কে অনুসরণ করার জন্য আল্লাহতালা হুকুম দিয়েছেন পবিত্র কোরআন শরিফের মধ্যে......
اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ
Ihdina alssirata almustaqeema
“আমাদের তুমি সহজ-সঠিক পথে পরিচালিত করো"
صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ
SIRAATAL LAZINA AN`AMTA `ALAYHIM; GHAYRILMAGHDOOBI `ALAYHIM WALADDAALEEN.
“তাদের পথে যাদের প্রতি তুমি নিয়ামত অর্পণ করেছ, তাদের ব্যতীত যাদের প্রতি গযব এসেছে, এবং তাদেরও নয় যারা পথভ্রষ্ট।"

এই আয়াতুল্লাহ দ্বারা পানীর মতো স্বচ্ছ হয়েগেল যে আল্লাহতালা তাদের পথে নিজের জীবন কে পরিচালনাকারী হতে বলছেন আলহামদুলিল্লাহ্‌।


সুফিবাদ উৎকর্ষ লাভ করে পারস্যে। সেখানকার প্রখ্যাত সুফি-দরবেশ, কবি-সাহিত্যিক এবং দার্শনিকগণ নানা শাস্ত্র, কাব্য ও ব্যাখ্যা-পুস্তক রচনা করে এই দর্শনকে সাধারণের নিকট জনপ্রিয় করে তোলেন। কালক্রমে বিখ্যাত ওলিদের অবলম্বন করে নানা তরিকা গড়ে ওঠে। সেগুলির মধ্যে কয়েকটি প্রধান তরিকা (পথ) সর্বাধিক প্রসিদ্ধি লাভ করে:---

(১)গাউসুল আজম বড় পির হযরত আবদুল কাদির জিলানি (রহমাতুল্লাহ আলাই.) প্রতিষ্ঠিত কাদেরিয়া তরিকা,

(২)সুলতানুল হিন্দ হযরত খাজা মু’ঈনুদ্দিন চিশতি (রহমাতুল্লাহ আলাই)প্রতিষ্ঠিত চিশতিয়া তরিকা,

(৩)হযরত খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দী (রহমাতুল্লাহ আলাই) প্রতিষ্ঠিত নকশবন্দিয়া তরিকা এবং

(৪)হযরত শেখ আহমদ মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানি সারহিন্দি (রহমাতুল্লাহ আলাই.) প্রতিষ্ঠিত মুজাদ্দিদিয়া তরিকা।

এছাড়া সুহ্‌রাওয়ার্দিয়া, নিজামী,আত্তারী,আক্তারী,রেজভী,নুরী, আহমদিয়া ও কলন্দরিয়া,ইত্যাদি ইত্যাদি  নামে মুল  তরিকার বিভিন্ন শাখামূল ভাগ বর্তমান।।

সেই তরিকতের মনাহ চার ইমামের এক জন হলে খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দি রহমাতুল্লাহ আলাই।আমরা এখন উনার সংক্ষিপ্ত জীবনের উপর আলোচনা করি.....

তাঁর নাম মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ আল-বােখারি। নিজের পিতার সাথে কাপড় বােনা এবং তাতে নকশা তৈরী করার কারণে নকশবন্দ উপাধি দ্বারা এসদ্ধি লাভ করেছে। তিনি বােখারা হতে তিন মাইল দূরে সরে আরেফা এলাকায় ৭২৮ হিজরি সনে জন্মগ্রহণ করেন। ৩ রবিউল আওয়াল ৭৯১ হিজরিতে সােমবারে ওফাত লাভ করেন। ওফাতের সময় এ অসিয়ত করেন যে, আমার জানাযার সামনে এ কাবতাটি পাঠ করবে,

مفلسانیم آمده در کوے تو 
شيئا لله از جمال روے تو
অর্থাৎ----
"অসহায় নিঃস্ব এসেছি তােমার গলিতে
তােমার চেহারার শােভা হতে আল্লাহর জ্যোতি নীতি।"

তিনি বলেন, উম্মত তিন ধরনের:--
 এক. উম্মতে দাওয়াত অর্থাৎ সকল মানুষ মুসলিম ও অমুসলিম নির্বিশেষে।

দুই. উম্মতে এজাবত অর্থাৎ মুসলমান।

তিন. উম্মতে মুতাবাআত যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্ণ অনুসারী।

একদিন কেউ তার নিকট কারামত তলব করল। তিনি বললেন, আমার কারামত এটি যে, পাপী হওয়া সত্ত্বেও না তাে জমিন আমাকে উগরে ফেলেছে আর

আসমান হতে আযাব নাযিল হয়। কেউ তাকে জনাকীর্ণ পরিবেশে খিলওয়াত (নির্জনতার) মর্মার্থ জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি বললেন, দৃশ্যতঃ মাখলুকের সাথে হওয়া এবং অন্তরের দিক দিয়ে আল্লাহর সাথে হওয়া। ঐ ব্যক্তি বলল, এটা কীভাবে সম্ভব? তিনি বললেন, আল্লাহর বাণী রয়েছে,
. رجال لا تلهيهم تجرة ولا بيع عن ذكر الله
"এমন লােকেরা, যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে, নামায কায়েম করা থেকে এবং যাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না।"
(আল-কুরআন, সূরা নূর, আয়াত : ৩১)

বুখারায় জনৈক আলেম তাকে জিজ্ঞাসা করল, নামাজে হুজরী কীভাবে অর্জন হয়? তিনি বললেন, হালাল খাদ্য দ্বারা যা যাচাই-বাচাই ও সাবধানতার সাথে ভক্ষণ করা হয় আর এর দ্বারা সমস্ত সময়ে বিশেষ করে নামাজে হুজুরী অর্জন হয় ।

তিনি আল্লাহর মা'রিফাতের রাস্তায় স্বয়ং মানব সত্তাকে বড় আড়াল হওয়ার ব্যাপারে বলেন, তােমার পর্দা বা আড়াল তােমার সত্তা।
دع نفسك وتعال
(স্বীয় নফসকে দরজায় ছেড়ে দাও এবং আল্লাহর মা'রিফাতে ডুব দাও ।)

মন্দলােকের সান্নিধ্য হতে বেঁচে থাকার ব্যাপারে বলেন, যে ব্যক্তির যােগ্যতার প্রতিভা মন্দলােকদের সঙ্গ দ্বারা নষ্ট হয়ে গেছে, তার অবস্থা সংশােধন করা কঠিন। তবে চিন্তাশীলদের সুহবত, যারা খুবই বিরল।

একদিন তিনি বলেন, ইস্তিকামতের (দৃঢ়পদী) তালেব হয়ে কারামতের তালেব হয়ােনা। কেননা, তােমার প্রতিপালক তােমার নিকট হতে ইস্তিকামত তলব করেন আর তােমার নফস তােমার নিকট হতে কারামত তলব করেন।

তাকে সেমা (আধ্যাত্মিক সংগীত) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, আমি তা অস্বীকারও করিনা, আর না তা করে থাকি।

 তিনি বলেন, আমাদের তরীকত হচ্ছে আদবের ওপর ভিত্তি।
 তরীকত পন্থীদের জন্য প্রথম শর্ত হচ্ছে আদব । আদবের তিনটি প্রকার রয়েছে।
 এক প্রকার আদব আল্লাহ তা'আলার সাথে সম্পর্কীত।

দ্বিতীয় প্রকার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে এবং

তৃতীয় প্রকার তরীকতের মশায়েখদের সাথে।

আল্লাহ তা'আলার আদব এই যে, যাহের-বাতেন বান্দা পূর্ণাঙ্গ বন্দেগীর শর্তে তার বিধানাবলী পালন করবে এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য সকল কিছু হতে সম্পূর্ণভাবে বিমুখ হয়ে যাবে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আদব এই যে, তাঁর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ ও অনুকরণ করবে আর সকল অবস্থায় তার হকসমূহকে চোখের সামনে রাখবে। তাকে সকল সৃষ্টিজগত ও আল্লাহর মধ্যে সম্বন্ধকারী মনে করব। যে যত মহান হােক না কেন, তার মাথা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইজ্জত-আলয়ের সামনে অবনর্মিত।

| তৃতীয় আদব তরীকদের মশায়েখদের সাথে। তালেবদের জন্য আবশ্যক। যে, ঐ সকল মশায়েখ, যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে, তাদের আদবকে সর্বাবস্থায় ওয়াজিব মনে করবে।

একদিন তিনি বলেন, যিকিরের উদ্দেশ্য এই যে, যিকিরকারী কলেমায়ে তাওহীদের হাকীকতকে পেয়ে নিবে আর এর হাকীকত এই যে, কলেমা পাঠকারা। আল্লাহ ছাড়া অন্য সকল বস্তু হতে সম্পূর্ণভাবে সম্পর্কহীন ও মুক্ত হয়ে যাবে।
একদিন তিনি মক্কায় দুইজন ব্যক্তিকে দেখলেন। তাদের মধ্যে একজন বই সাহসা এবং আরেকজন খুবই কাপুরুষ ছিল। কাপুরুষ ছিল ঐ ব্যক্তি, যাকে আমি তাওয়াফ করতে দেখেছি। অতঃপর ঐ ব্যক্তি খানায়ে কাবায় হাত রেখে আল্লাহ ছাড়া অন্য বস্তুর জন্য প্রার্থনা করছে।

আর উঁচু সাহসী ছিল ঐ যুবক, যাকে আমি মিনার বাজারে পঁচিশ হাজার দিরহামের লেনদেন করতে দেখেছি। কিন্তু তখন এক মুহূর্তের জন্যও তার অন্তর আল্লাহর স্মরণ হতে বিরত হয়নি।

আরেফদেরকে সফলতার সাথে মঞ্জিলে মাকসুদের পথনির্দেশ করতে গিয়ে বলেন, ঐ রাস্তা, যার মাধ্যমে আরেফরা প্রকৃত উদ্দেশ্যকে পেয়ে নেয় এবং অন্যরা বঞ্চিত থাকে, তা তিনটি। মুরাকাবা, মুশাহাদ ও মুহাসাবা।

আল্লাহর দিকে সর্বদা দৃষ্টি দেয়া এবং মাখলুক হতে অমনােযােগী হওয়াকে মুরাকাবা বলা হয়। অর্থাৎ তরীকত পন্থীদের উচিত, তারা সর্বদা আল্লাহর সত্তার দিকে মনােনিবেশ করবে এবং মাখলুকের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করবে । যখন মুশাহাদা দ্বারা উদ্দেশ্য ঐ সকল গায়বী বিষয়বস্তুর প্রত্যক্ষ লাভ, যা অন্তরে অবতারিত হয় । আগত জিনিস দ্রুত চলে যায় । স্থির থাকেনা। অতএব তা আমরা বুঝতে পারিনা। তবে গুণাবলীর প্রসারণ ও সংকোচন দ্বারা এটি অনুমান হয়ে যায়। কজের মধ্যে সিফাতে জালালের (মাহাত্ম) মুশাহাদা করানাে হয় এবং বসতের মধ্যে সিফাতে জামালের সৌন্দর্য)।

মুহাসাবা এই যে, প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের ওপর যা কিছু ঘটে যায়, তা পরখ করে দেখানাে। তাতে কি গাফলতী করেছি নাকি হুজুরী করেছি। যদি পুরােপুরিভাবে ক্ষতি হয়, তাহলে চিন্তা করব এবং আমলকে নতুনভাবে শুরু করব। কামিয়াবীর সীমাবদ্ধতা এই পথের পথিক হওয়ার মধ্যেই।


Saturday 19 May 2018

মাযার নির্মাণসম্পর্কিত আহলুস্ সুন্নাহ’র ফতোওয়া

মাযার নির্মাণসম্পর্কিত আহলুস্ সুন্নাহ’র ফতোওয়া


[Bengali translation of www.ahlus-sunna.com's fatwa entitled "Building Structures over Graves & Recitation of Quran there." Translator: Kazi Saifuddin Hossain]

মূল: ডব্লিউ,ডব্লিউ,ডব্লিউ-ডট-আহলুস-সুন্নাহ-ডট-কম

অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

[উৎসর্গ: পীর ও মোর্শেদ আউলিয়াকুল শিরোমণি সৈয়দ মওলানা এ, জেড, এম, সেহাবউদ্দীন খালেদ সাহেব কেবলা (রহ:)-এর পুণ্যস্মৃতিতে....]

জরুরি জ্ঞাতব্য 



ইসলাম-বিদ্বেষী চক্র পায়ের ওপর পা রেখে বসে নিশ্চয় ভাবছে, আহ, কী মজা! আমরা বৃটিশের সহায়তায় মুসলমানদের মধ্যে এমন একটি দল সৃষ্টি করেছি, যারা সেই কাজ করতে পারবে যা আমরা যুগ যুগ ধরে পারিনি (অর্থাৎ, তথাকথিত মুসলমানদের হাতে ইসলামী ঐতিহ্যবাহী পুণ্যময় স্থানগুলো ধ্বংস করে মুসলিম বিশ্বে গণ্ডগোল-হট্টগোল বাধানো)।



এ কাজে বাধা দেয়া না গেলে শয়তান (ইবলীস)-এর মূল লক্ষ্য হবে কা’বা শরীফ (যা’তে রয়েছে মাকাম আল-ইবরাহীম তথা তাঁর কদম মোবারকের ছাপবিশিষ্ট পুণ্যস্থান; এর পবিত্রতা কুরআনের ‘নস’ দ্বারা সমর্থিত) ধ্বংস করা; আর এর সাথে মহানবী (ﷺ)-এর রওযা শরীফ-সহ অন্যান্য শআ’রিল্লাহ (সম্মান প্রদর্শনযোগ্য স্থান)-কেও ধ্বংস করা; কেননা, রওযা-এ-আকদস (রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের মাযার)-কে অনেক ওহাবী লেখনীতে সর্ববৃহৎ মূর্তি বলে প্রচার করা হয়েছে।

মাযার নির্মাণ ও সেখানে কুরআন তেলাওয়াত   


বর্তমানে কতিপয় মুসলমান ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে যে মহানবী (ﷺ)-সহ ঈমানদার পুণ্যাত্মাবৃন্দের মাযার-রওযা যেয়ারত করে কেউ তাঁদেরকে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার সময় ওসীলা বা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে গ্রহণ করলে বা তাঁদের স্মৃতিবহ কোনো জিনিসকে বরকত আদায়ের মাধ্যম মনে করলে শেরক কিংবা বেদআত হবে। ভ্রান্তদের মধ্যে কেউ কেউ এমনও দাবি করে যে এই কাজ সাহাবা-এ-কেরাম
 (رضي الله عنه)-বৃন্দ করেননি, বিগত শতাব্দীগুলোতেও এগুলো অনুশীলিত হয়নি; আর মাযার-রওযার ওপর স্থাপত্য নির্মাণও শরীয়তে আদিষ্ট হয়নি। তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর রওযা শরীফের ওপর নির্মিত সবুজ গুম্বজকে বেদআত আখ্যা দিয়ে থাকে (’সালাফী’গুরু নাসিরুদ্দীন আলবানী এটির প্রবক্তা)। আমরা চূড়ান্তভাবে কুরআন ও হাদীসের আলোকে এতদসংক্রান্ত ফায়সালা এক্ষণে অনুধাবন করবো:



কুরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে, “এবং এভাবে আমি তাদের (আসহাবে কাহাফ) বিষয় জানিয়ে দিলাম, যাতে লোকেরা জ্ঞাত হয় যে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য এবং কিয়ামতে কোনো সন্দেহ নেই; যখন এই সব লোক তাদের (আসহাবে কাহাফ) ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে বিতর্ক করতে লাগলো, অতঃপর তারা বল্লো, ’তাদের গুহার ওপর কোনো ইমারত নির্মাণ করো! তাদের রব (খোদা)-ই তাদের বিষয়ে ভাল জানেন। ওই লোকদের মধ্যে যারা (এ বিষয়ে) ক্ষমতাধর ছিল তারা বল্লো, ‘শপথ রইলো, আমরা তাদের (আসহাবে কাহাফের পুণ্যময় স্থানের) ওপর মসজিদ নির্মাণ করবো’।” [সূরা কাহাফ, ২১ আয়াত]  



ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) এই আয়াতের তাফসীরে লেখেন, “কেউ কেউ (ওদের মধ্যে) বলেন যে গুহার দরজা বন্ধ করে দেয়া হোক, যাতে আসহাবে কাহাফ আড়ালে গোপন থাকতে পারেন। আরও কিছু মানুষ বলেন, গুহার দরজায় একটি মসজিদ নির্মাণ করা হোক। তাঁদের এই বক্তব্য প্রমাণ করে যে এই মানুষগুলো ছিলেন ’আল্লাহর আরেফীন (আল্লাহ-জ্ঞানী), যাঁরা এক আল্লাহর এবাদত-বন্দেগীতে বিশ্বাস করতেন এবং নামাযও পড়তেন’।” [তাফসীরে কবীর, ৫ম খণ্ড, ৪৭৫ পৃষ্ঠা]



ইমাম রাযী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) আরও লেখেন: “এবং আল্লাহর কালাম - ‘(এ বিষয়ে) যারা ক্ষমতাশালী’ বলতে বোঝানো হয়ে থাকতে পারে ‘মুসলমান শাসকবৃন্দ’, অথবা আসহাবে কাহাফ (মো’মেনীন)-এর বন্ধুগণ, কিংবা শহরের নেতৃবৃন্দ। ‘আমরা নিশ্চয় তাদের স্মৃতিস্থানের ওপরে মসজিদ নির্মাণ করবো’ - এই আয়াতটিতে এ কথাই বোঝানো হয়েছে, ‘আমরা যাতে সেখানে আল্লাহর এবাদত-বন্দেগী করতে পারি এবং এই মসজিদের সুবাদে আসহাবে কাহাফ তথা গুহার সাথীদের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ করতে পারি’।”
 [তাফসীরে কবীর, ৫ম খণ্ড, ৪৭৫ পৃষ্ঠা]



অতএব, যারা মাযার-রওযা ধ্বংস করে এবং আল্লাহর আউলিয়াবৃন্দের প্রতি বিদ্বেষভাব প্রদর্শন করে, তারা কুরআন মজীদের সূরা কাহাফে বর্ণিত উপরোক্ত সুস্পষ্ট আয়াতের সরাসরি বিরোধিতা করে। অথচ কুরআন মজীদ স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে যে আউলিয়া কেরাম (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর মাযার-রওযা নির্মাণ ও তাঁদের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ বৈধ। এটি কুরআনের ‘নস’ (দলিল), যাকে নাকচ করা যায় না; এমন কি কোনো হাদীস দ্বারাও নয়। সুতরাং সীমা লঙ্ঘনকারীরা যতো হাদীসের অপব্যাখ্যা করে এ ব্যাপারে অপপ্রয়োগ করে থাকে, সবগুলোকে ভিন্নতর ব্যাখ্যা দিতে হবে। অর্থাৎ, ‘সাধারণ মানুষের’ কবর নির্মাণ করা যাবে না (তবে একবার নির্মিত হলে তা ভাঙ্গাও অবৈধ)। কিন্তু আম্বিয়া  ও আউলিয়া (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর মাযার-রওযা অবশ্যঅবশ্যই নির্মাণ করা জায়েয বা বৈধ, যেমনটি আমরা দেখতে পাই মদীনা মোনাওয়ারায় মহানবী (ﷺ) এবং সর্ব-হযরত আবূ বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه) ও উমর ফারূক (رضي الله عنه)-এর রওযা মোবারক সবুজ গুম্বজের নিচে সুশোভিত আছে। সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-ই এই রওযাগুলো নির্মাণ করেন যা শরীয়তের দলিল।
 [জরুরি জ্ঞাতব্য: সউদী, বৃটিশ ও মার্কিন তহবিলপুষ্ট ‘পণ্ডিতেরা’ এই সকল পবিত্র স্থানকে মসজিদে নববী থেকে অপসারণের অসৎ পরিকল্পনায় মাযার-রওযার বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নেমেছে - নাউযুবিল্লাহ!]



’তাফসীরে জালালাইন’ শিরোনামের বিশ্বখ্যাত সংক্ষিপ্ত ও সহজে বোধগম্য আল-কুরআনের ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থে ইমাম জালালউদ্দীন সৈয়ুতী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) ও আল-মোহাল্লী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) লেখেন: ”(মানুষেরা বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিল), অর্থাৎ, বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীরা (ওই) তরুণ (আসহাবে কাহাফ)-দের বিষয়ে বিতর্ক করছিল যে তাঁদের পার্শ্বে কোনো স্মৃতিচিহ্ন নির্মাণ করা যায় কি-না। এমতাবস্থায় অবিশ্বাসীরা বলে, তাঁদেরকে ঢেকে দেয়ার জন্যে ইমারত নির্মাণ করা হোক। তাঁদের প্রভু-ই তাঁদের অবস্থা সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত। কিন্তু যে মানুষেরা ওই তরুণ আসহাবে কাহাফের বিষয়ে বেশি প্রভাবশালী ছিলেন, মানে বিশ্বাসীরা, তারা বল্লেন, আমরা তাঁদের পার্শ্বে এবাদতের উদ্দেশ্যে মসজিদ নির্মাণ করবো। আর এটি গুহার প্রবেশপথে প্রকৃতই নির্মিত হয়েছিল। [তাফসীর আল-জালালাইন, ১ম খণ্ড, ৩৮৯ পৃষ্ঠা]



ইমাম নাসাফী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) নিজ ‘তাফসীরে নাসাফী’ পুস্তকে লেখেন: “যারা (আসহাবে কাহাফের বিষয়ে) প্রভাবশালী ছিলেন, তারা মুসলমান এবং শাসকবর্গ; এরা বলেন যে গুহার প্রবেশপথে একটি মসজিদ নির্মাণ করে দেবেন, যাতে ‘মুসলমানবৃন্দ সেখানে এবাদত-বন্দেগী করতে পারেন এবং তা (স্মৃতিচিহ্ন) থেকে বরকত আদায় করতে সক্ষম হন’।” [তাফসীর আল-নাসাফী, ৩য় খণ্ড, ১৮ পৃষ্ঠা]



ইমাম শেহাবউদ্দীন খাফফাজী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) লেখেন: “(গুহামুখে মসজিদ নির্মাণ) সালেহীন তথা পুণ্যাত্মাবৃন্দের মাযার-রওযার পার্শ্বে মসজিদ নির্মাণের প্রামাণিক দলিল, যেমনটি উল্লেখিত হয়েছে ‘তাফসীরে কাশশাফ’ পুস্তকে; আর এই দালানের ভেতরে এবাদত-বন্দেগী করা ’জায়েয’ (বৈধ)।” [ইমাম খাফফাজী কৃত ‘এনায়াতুল কাদী’, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ৮৭ পৃষ্ঠা; দারুস্ সাদির, বৈরুত, লেবানন হতে প্রকাশিত]



ইমাম মোহাম্মদ বিন হাসান শায়বানী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, “হযরত ইমাম আবূ হানিফাহ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) আমাদের জানিয়েছেন এই বলে যে সালিম আফতাস্ আমাদের (তাঁর কাছে) বর্ণনা করেন: ‘এমন কোনো নবী নেই যিনি কা’বা শরীফে আল্লাহর এবাদত-বন্দেগী করতে নিজ জাতিকে ছেড়ে আসেন নি; আর এর আশপাশে ৩০০ জন নবী (আ:)-এর মাযার-রওযা বিদ্যমান’।” [ইমাম শায়বানীর ‘কিতাবুল আসার’; লন্ডনে Turath Publishing কর্তৃক প্রকাশিত; ১৫০ পৃষ্ঠা]



ইমাম শায়বানী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) আরও বলেন, “ইমাম আবূ হানিফা (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) আমাদেরকে জানিয়েছেন এই বলে যে হযরত আতা’ বিন সায়েব (رضي الله عنه) আমাদের (তাঁর কাছে) বর্ণনা করেন, ‘আম্বিয়া সর্ব-হযরত হুদ (আ:), সালেহ (আ:) ও শোয়াইব (আ:)-এর মাযার-রওযা মসজিদে হারামে অবস্থিত’।” [প্রাগুক্ত]



ইমাম ইবনে জারির তাবারী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) নিজ ‘তাফসীরে তাবারী’ পুস্তকে লেখেন: “মুশরিকরা বলেছিল, আমরা গুহার পার্শ্বে একটি ইমারত নির্মাণ করবো এবং আল্লাহর উপাসনা করবো; কিন্তু মুসলমানগণ বলেন, আসহাবে কাহাফের ওপর আমাদের হক বেশি এবং নিশ্চয় আমরা ওখানে ‘মসজিদ নির্মাণ করবো’ যাতে আমরা ওতে আল্লাহর এবাদত-বন্দেগী করতে পারি।” [তাফসীরে তাবারী, ১৫:১৪৯]



মোল্লা আলী কারী ওপরে উদ্ধৃত আয়াতের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন: “যে ব্যক্তি কোনো সত্যনিষ্ঠ বোযর্গ বান্দার মাযারের সন্নিকটে মসজিদ নির্মাণ করেন, কিংবা ওই মাযারে (মাক্কবারা) এবাদত-বন্দেগী করেন, অথবা উক্ত বোযর্গের রূহ মোবারকের অসীলায় (মধ্যস্থতায়) সাহায্য প্রার্থনা করেন, বা তাঁর রেখে যাওয়া কোনো বস্তু থেকে বরকত তথা আশীর্বাদ অন্বেষণ করেন, তিনি যদি (এবাদতে) ওই বোযর্গকে তা’যিম বা তাওয়াজ্জুহ পালন না করেই এগুলো করেন, তবে এতে কোনো দোষ বা ভ্রান্তি নেই। আপনারা কি দেখেননি, মসজিদে হারামের ভেতরে হাতীম নামের জায়গায় হযরত ইসমাঈল (আ:)-এর রওযা শরীফ অবস্থিত? আর সেখানে এবাদত-বন্দেগী পালন করা অন্যান্য স্থানের চেয়েও উত্তম। তবে কবরের কাছে এবাদত-বন্দেগী পালন তখনই নিষিদ্ধ হবে, যদি মৃতের নাজাসাত (ময়লা) দ্বারা মাটি অপবিত্র হয়ে যায়। ....হাজর আল-আসওয়াদ (কালো পাথর) ও মিযা’য়াব-এর কাছে হাতীম জায়গাটিতে ’৭০জন নবী (আ:)-এর মাযার-রওযা’ বিদ্যমান।”
 [মিরক্কাত শরহে মিশক্কাত, ২য় খণ্ড, ২০২ পৃষ্ঠা]



ইমাম আবূ হাইয়ান আল-আনদালুসী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন: “তাঁদের (আসহাবে কাহাফের) পার্শ্বে ইমারত নির্মাণের কথা যে ব্যক্তি বলেছিল, সে এক অবিশ্বাসী মহিলা। সে গীর্জা নির্মাণের কথা-ই বলেছিল, যেখানে কুফরী কাজ করা যেতো। কিন্তু মো’মেন বান্দারা তাকে থামিয়ে দেন এবং ওর পরিবর্তে মসজিদ নির্মাণ করেন।” 
[তাফসীরে বাহর আল-মুহীত, ৭ম খণ্ড, ১৫৮ পৃষ্ঠা]



ইবনুল জাওযী, যাকে কট্টর হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং ‘সালাফী’রাও মানে, তিনি উক্ত আয়াতের (১৮:২১) তাফসীরে বলেন: “ইবনে কুতায়বা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে মুফাসসিরীনবৃন্দ মত প্রকাশ করেছিলেন, ওখানে যাঁরা মসজিদ নির্মাণ করেন, তাঁরা ছিলেন মুসলমান রাজা ও তাঁর মো’মেন সাথীবৃন্দ।” [তাফসীরে যা’য়াদ আল-মাসীর, ৫ম খণ্ড, ১২৪ পৃষ্ঠা]

সুস্পষ্ট হাদীস শরীফ


হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীস, যিনি বলেন: “মসজিদে আল-খায়ফের মধ্যে (’ফী’) ৭০ জন নবী (আ:)-এর মাযার-রওযা (এক সাথে) বিদ্যমান।” ইমাম আল-হায়তামী (رضي الله عنه) বলেন যে এটি আল-বাযযার বর্ণনা করেন এবং ”এর সমস্ত রাবী (বর্ণনাকারী)-ই আস্থাভাজন”। মানে এই হাদীস সহীহ। ইমাম আল-হায়তামী (رضي الله عنه) নিজ ‘মজমাউয্ যাওয়াইদ’ পুস্তকের ৩য় খণ্ডে ‘বাবু ফী মসজিদিল্ খায়ফ’ অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ #৫৭৬৯ নং হাদীসটি উদ্ধৃত করেন, যা’তে বিবৃত হয়: “মসজিদে খায়ফের মধ্যে (’ফী’) ৭০ জন আম্বিয়া (আ:)-এর মাযার-রওযা বিদ্যমান।” 



হুকুম: শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) এ প্রসঙ্গে বলেন, “এই হাদীসের সনদ সহীহ।” [মোখতাসারুল বাযযার, ১:৪৭৬]



আল-কুরআন ও হাদীস শরীফের এই সমস্ত ‘নস’ তথা দালিলিক প্রমাণ থেকে পরিস্ফুট হয় যে আম্বিয়া (আ:) ও আউলিয়া (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-বৃন্দের মাযার-রওযায় ইমারত নির্মাণ করা ইসলামে বৈধ ও সওয়াবদায়ক কাজ। সীমা লঙ্ঘনকারীরা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদেরকে ’মুশরিকীন’ বা মূর্তিপূজারী বলে আখ্যা দেয় এই বলে যে মাযার-রওযাগুলো হচ্ছে ‘মূর্তির ঘর’ (নাউযুবিল্লাহ); আর তাই বুযূর্গানে দ্বীনের মাযার, এমন কি মহানবী (ﷺ)-এর রওযা শরীফও ধ্বংস করতে হবে বা মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। জান্নাতে বাকী ও মু’য়াল্লায় বহু সাহাবা-এ-কেরামে (رضي الله عنه)-এর মাযার-রওযা এভাবে তারা গুঁড়িয়ে দেবার মতো জঘন্য কাজ করেছে। কিন্তু মুসলমানদের চাপে তারা হুযূর পূর নূর (ﷺ)-এর রওযা শরীফ ভাঙ্গতে পারেনি।



আল-কুরআনের ২য় ‘নস’(দলিল)



আল্লাহ পাক তাঁর পবিত্র কুরআনে এরশাদ ফরমান: “এবং স্মরণ করুন, যখন আমি এ ঘরকে (কা’বা শরীফকে) মানবজাতির জন্যে আশ্রয়স্থল ও নিরাপদ স্থান করেছি; আর (বল্লাম), ‘ইবরাহীমের দাঁড়াবার স্থানকে (মাকামে ইবরাহীম নামের পাথরকে যার ওপর দাঁড়িয়ে তিনি কা’বা ঘর নির্মাণ করেন) নামাযের স্থান হিসেবে গ্রহণ করো’; এবং ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে তাকিদ দিয়েছি, ‘আমার ঘরকে পুতঃপবিত্র করো, তাওয়াফকারী, এ’তেকাফকারী এবং রুকু’ ও সেজদাকারীদের জন্যে।” (জ্ঞাতব্য: তাওয়াফের পরে দু’রাকআত নামায ওখানে পড়তে হয়
[সূরা বাকারাহ, ১২৫ আয়াত; মুফতী আহমদ এয়ার খানের ’নূরুল এরফান’ বাংলা তাফসীর থেকে সংগৃহীত; অনুবাদক: মওলানা এম, এ, মন্নান, চট্টগ্রাম]



আল-কুরআনের অন্যত্র এরশাদ হয়েছে: "সেটির মধ্যে সুস্পষ্ট নিদর্শনাদি রয়েছে - ইবরাহীমের দাঁড়াবার স্থান (মাকাম-এ-ইব্রাহীম); আর যে ব্যক্তি সেটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে, সে নিরাপত্তার মধ্যে থাকে; এবং আল্লাহর জন্যে মানবকুলের ওপর ওই ঘরের হজ্জ্ব করা (ফরয), যে ব্যক্তি সেটি পর্যন্ত যেতে পারে। আর যে ব্যক্তি অস্বীকারকারী হয়, তবে আল্লাহ সমগ্র জাহান (জ্বিন ও ইনসান) থেকে বে-পরোয়া।”
 [সূরা আল-এ-ইমরান, ৯৭ আয়াত; মুফতী আহমদ এয়ার খান কৃত ‘নূরুল এরফান’ তাফসীর হতে সংগৃহীত]  



আল্লাহতা’লা তাঁর প্রিয় বন্ধুদের এতো ভালোবাসেন যে ‘এই ধরনের নির্দিষ্ট বা চিহ্নিত করা স্থানে’ প্রার্থনা করাকে তিনি হজ্জ্বের প্রথা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এতে যদি বিন্দু পরিমাণ শেরকের (অংশীবাদের বা মূর্তিপূজার) সম্ভাবনা থাকতো, অর্থাৎ, মানুষেরা আম্বিয়া (আ:)-এর মাযার-রওযা ও পদচিহ্নকে ‘আল্লাহ ভিন্ন অন্য উপাস্য দেবতা’ হিসেবে যদি গ্রহণ করা আরম্ভ করতো, তাহলে আল্লাহতা’লা নিজ কুরআন মজীদে তাঁর অবারিত রাজকীয় সম্মান তাঁরই প্রিয় বন্ধুদের প্রতি দেখাতেন না।



বস্তুতঃ পবিত্র কুরআন মজীদ এই সব স্থানকে ‘শআয়েরুল্লাহ’ (আল্লাহকে স্মরণ হয় এমন সম্মান প্রদর্শনযোগ্য চিহ্ন) হিসেবে সম্বোধন করে; আর আম্বিয়া (আ:) ও আউলিয়া (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-বৃন্দের মাযার-রওযা (নবীদের কারো কারো রওযা মসজিদে হারামের মধ্যেও বর্তমান) অবশ্যঅবশ্য শআয়েরুল্লাহ’র অন্তর্ভুক্ত। যে কেউ এই মাযার-রওযার ক্ষতি করলে প্রকৃতপ্রস্তাবে আল্লাহতা’লার সাথেই যুদ্ধে জড়িয়ে যাবে, যেমনটি সহীহ বেখারী শরীফে বর্ণিত একটি হাদীসে কুদসীতে ঘোষিত হয়েছে: “যে ব্যক্তি আমার ওলী (বন্ধু)’র প্রতি বৈরীভাবাপন্ন হয়, তাকে আমি আমার সাথে যুদ্ধ করার জন্যে আহ্বান জানাই।” [সহীহ বোখারী, হাদীসে কুদসী, ৮ম খণ্ড, ১৩১ পৃষ্ঠা]



বিরোধীরা হয়তো ধারণা করতে পারে যে তারা হয়তো মাযার-রওযা ভেঙ্গে কোনো না কোনোভাবে আল্লাহর সাথে যুদ্ধে জয়ী হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে আল্লাহতা’লা ওহাবী/’সালাফী’ গোষ্ঠীর নিষ্ঠুর ও বর্বরতা প্রকাশ করে দিয়ে আহল্ আস্ সুন্নাহ’র শিক্ষাকেই সারা বিশ্বে প্রচার-প্রসার করছেন। সীমা লঙ্ঘনকারীদের জঘন্য কাজের পরে আহল্ আস্ সুন্নাহ (সুন্নী মুসলমানবৃন্দ) বিশ্বব্যাপী গোমরাহদের বদ আকীদার খণ্ডন করছেন, এবং আল-হামদু লিল্লাহ, এটি নিশ্চয় আল-ফাতহুল বারী (খোদাতা’লার বিজয় তথা তাঁর পক্ষ হতে বিজয়), যা সীমা লঙ্ঘনকারীরা উপলব্ধি করতে পারছে না। আল্লাহ হলেন সবচেয়ে সেরা পরিকল্পনাকারী এবং তিনি তাঁর সালেহীন বা পুণ্যবান বান্দাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী লোকদেরকে জমিনের ওপর তাদের ধ্বংসযজ্ঞ/নৈরাজ্য চালানোর ক্ষণিক সুযোগ দেন; কিন্তু বাস্তবে তাদের প্রতি আল্লাহর লা’নত বা অভিসম্পাত বর্ষিত হয়, যেমনটি আল-কুরআন এরশাদ ফরমায়:



”এবং ওই সব লোক, যারা আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকারকে তা পাকাপাকি হবার পর ভঙ্গ করে, এবং যা জুড়ে রাখার জন্যে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, সেটি ছিন্ন করে এবং জমিনে ফাসাদ ছড়ায়, তাদের অংশ হচ্ছে অভিসম্পাত-ই এবং তাদের ভাগ্যে জুটবে মন্দ আবাস-ঘর।”
 [সূরা রা’দ, ২৫ আয়াত]



অতএব, এ ধরনের লা’নতপ্রাপ্ত লোকেরা জমিনের ওপর ফাসাদ (বিবাদ-বিসম্বাদ) সৃষ্টি করে এবং পবিত্র স্থানগুলো ধ্বংস করে। তারা মনে করে যে তারা সত্যপথে আছে, কিন্ত বাস্তবে খারেজী-সম্পর্কিত আল-বোখারীর হাদীসে যেমন প্রমাণিত, ঠিক তেমনি তারাও খারেজীদের মতোই পথভ্রষ্ট হয়েছে।



আল্লাহতা’লা এরশাদ করেন, 
নিশ্চয় শয়তান তোমাদের শত্রু; সুতরাং তোমরাও তাকে শত্রু মনে করো। সে তো আপন দলকে এ জন্যেই আহ্বান করে যেন তারা দোযখীদের অন্তর্ভুক্ত হয়” (সূরা ফাতির, ৬ আয়াত)।
 ইমাম আহমদ আল-সাবী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) ইমাম জালালউদ্দীন সৈয়ুতী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর কৃত ‘তাফসীরে জালালাইন’ গ্রন্থের চমৎকার হাশিয়ায় এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লেখেন: “এ কথা বলা হয় যে এই আয়াতটি খারেজীদের (ভবিষ্যতে আবির্ভাব) সম্পর্কে নাযেল হয়েছিল, যারা কুরআন-সুন্নাহ’র অর্থ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পরিবর্তন করেছিল এবং এরই ভিত্তিতে মুসলমান হত্যা ও তাঁদের ধন-সম্পত্তি লুঠপাটকে বৈধ জ্ঞান করেছিল, যেমনটি আজকাল দেখা যায় তাদের উত্তরসূরী হেজায অঞ্চলের ওহাবীদের মাঝে। ওহাবীরা ‘এ কথা মনে করছে তারা (বড় কূটনীতিমূলক) কিছু করেছে। ওহে শুনছো, নিশ্চয় তারাই মিথ্যুক। তাদের ওপর শয়তান বিজয়ী হয়ে গিয়েছে, সুতরাং সে তাদেরকে ভুলিয়ে দিয়েছে আল্লাহর স্মরণ। তারা শয়তানের দল। শুনছো! নিশ্চয় শয়তানের দল-ই ক্ষতিগ্রস্ত’ (আল-কুরআন, ৫৮:১৮-৯)। আমরা আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করি যাতে তিনি তাদেরকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেন। 
[হাশিয়া আল-সাবী আ’লাল জালালাইন, ৩:২৫৫]



জরুরি জ্ঞাতব্য: ওহাবীরা ধূর্ততার সাথে এই বইটির মধ্য থেকে ‘ওহাবী’ শব্দটি অপসারণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা হাতে-নাতে ধরা পড়ে যায়। আল্লাহতালা-ই ইসলামী জ্ঞানকে হেফাযত করেন।



দলিল নং - ১ 



আমরা এবার ‘কবরের আকার-আকৃতি’ বিষয়টির ফয়সালা করবো।



হযরত আবূ বকর বিন আইয়াশ (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন: হযরত সুফিয়ান আত্ তাম্মার (رضي الله عنه) আমাকে জানান যে তিনি মহানবী (ﷺ)-এর রওযা মোবারককে উঁচু ও উত্তল দেখতে পেয়েছেন। [সহীহ বোখারী, ২য় খণ্ড, ২৩তম বই, হাদীস নং ৪৭৩]



অতএব, মাযার-রওযা ভেঙ্গে ফেলা বা গুঁড়িয়ে দেয়া ‘সালাফী’দের দ্বারা ‘নস’ বা শরয়ী দলিলের চরম অপব্যাখ্যা ছাড়া কিছুই নয়।



মহান হানাফী মুহাদ্দীস ইমাম মোহাম্মদ ইবনে হাসসান শায়বানী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) এতদসংক্রান্ত বিষয়ে গোটা একটি অধ্যায় বরাদ্দ করে তার শিরোনাম দেন ‘কবরের ওপর উঁচু স্তূপাকৃতির ফলক ও আস্তর’। এই অধ্যায়ে তিনি নিম্নের হাদীসটি লিপিবদ্ধ করেন:



ইমাম আবূ হানিফা (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) আমাদের কাছে হযরত হাম্মাদ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর কথা বর্ণনা করেন, তিনি হযরত ইবরাহীম (رضي الله عنه)-এর কথা উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন, কেউ একজন আমাকে জানান যে তাঁরা মহানবী (ﷺ), হযরত আবূ বকর (رضي الله عنه) ও হযরত উমর (رضي الله عنه)-এর মাযার-রওযার ওপরে ‘উঁচু স্তূপাকৃতির ফলক যা (চোখে পড়ার মতো) বাইরে প্রসারিত ছিল তা দেখতে পেয়েছিলেন এবং তাতে আরও ছিল সাদা এঁটেলমাটির টুকরো।



ইমাম মোহাম্মদ (رضي الله عنه) আরও বলেন, আমরা (আহনা’ফ) এই মতকেই সমর্থন করি; মাযার-রওযা বড় স্তূপাকৃতির ফলক দ্বারা চিহ্নিত করতে হবে। কিন্তু তা বর্গাকৃতির হতে পারবে না। এটি-ই হচ্ছে ’ইমাম আবূ হানিফা (رضي الله عنه)-এর সিদ্ধান্ত’।
 [কিতাবুল আসা’র, ১৪৫ পৃষ্ঠা, Turath Publishing কর্তৃক প্রকাশিত]



সীমা লঙ্ঘনকারীরা দাবি করে, সকল মাযার-রওযা-ই গুঁড়িয়ে দিতে বা ধ্বংস করতে হবে। এটি সরাসরি সুন্নাহর সাথে সাংঘর্ষিক। কেননা, তারা যে হাদীসটিকে এ ক্ষেত্রে অপপ্রয়োগ করে, তা মুশরিকীন (অংশীবাদী)-দের সমাধি সম্পর্কে বর্ণিত, মো’মেনীন (বিশ্বাসী মুসলমান)-দের কবর সম্পর্কে নয়। মাযার-রওযা নির্মাণ বৈধ, কারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ), সর্ব-হযরত আবূ বকর (رضي الله عنه) ও উমর ফারূক (رضي الله عنه) এবং অন্যান্য সাহাবা (رضي الله عنه)-দের মাযার-রওযা উঁচু স্তূপাকৃতির ফলক দ্বারা নির্মিত হয়েছিল মর্মে দলিল বিদ্যমান। আমরা জানি, ওহাবীরা চিৎকার করে বলবে আমরা কেন ইমাম মোহাম্মদ (رضي الله عنه)-এর বইয়ের পরবর্তী পৃষ্ঠার উদ্ধৃতি দেই নি, যেখানে তিনি কবরে আস্তর না করার ব্যাপারে বলেছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে তিনি তাতে সাধারণ কবরের কথা-ই বলেছিলেন, আম্বিয়া (আ:) ও আউলিয়া (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর মাযার-রওযা সম্পর্কে নয়, যেমনিভাবে ইতিপূর্বে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আমরা এখানে কিছু ছবি দেখাতে চাই যা’তে দৃশ্যমান হয় যে মুশরিকীন/খৃষ্টানদের সমাধি এমন কি তাদের দ্বারাও (মাটির সাথে) ‘সমান’ রাখা হয় (অতএব, ইসলামী প্রথানুযায়ী মুসলমানদের কবর মাটির সাথে সমান নয়, বরং উচুঁ স্তূপাকৃতির ফলক দ্বারা মাটি থেকে ওপরে হওয়া চাই)। তবে খৃষ্টান সম্প্রদায় মরিয়ম ও যিশুর মূর্তি তাদের মৃতদের সমাধিতে স্থাপন করে যা ইসলাম ধর্মমতে নিষেধ। 
[অনুবাদকের নোট: এই ছবিগুলো পিডিএফ আকারে মিডিয়াফায়ার ও স্ক্রাইব্ড সাইটে প্রকাশ করা হয়েছে]



মুসলমানদের কবর ও মুশরিকীন (অংশীবাদী)-দের সমাধির মধ্যকার পার্থক্য বোঝার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ছবি 



(ক) প্রথম ছবিটিতে দেখা যায় খৃষ্টানদের সমাধি সম্পূর্ণভাবে মাটির সাথে মেশানো তথা মাটির সমান, যা ওহাবীরা আমাদের বিশ্বাস করতে বলে এই মর্মে যে, মুসলমানদের কবরও অনুরূপ হওয়া উচিত। 
[কিন্তু বেশ কিছু হাদীসে ইহুদী ও খৃষ্টানদের বিপরীত করতে আমরা আদিষ্ট হয়েছে, যা প্রমাণ করে যে মুসলমানদের কবর পাকা হওয়া উচিত; তবে কোনো মূর্তি ওর ওপরে নির্মাণ করা চলবে না]



(খ) দ্বিতীয় দুটি ছবিতে স্পষ্ট হয় যে খৃষ্টানগণ ‘সমাধির ঠিক ওপরে মূর্তি নির্মাণ করেন’। অথচ মুসলমান সূফী-দরবেশদের মাযার-রওযার ঠিক ওপরে ইমারত (অবকাঠামো) নির্মিত হয় না, বরং তাঁদের মাযার-রওযাগুলো দালান হতে পৃথক, যেটি বিভিন্ন হাদীসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, যে হাদীসগুলো এমন কি ওহাবীরাও অপপ্রয়োগ করে থাকে।



পক্ষান্তরে, নিচের ছবিগুলো ইসলামের অত্যন্ত পবিত্র স্থানসমূহের, যা’তে অন্তর্ভুক্ত মহানবী (ﷺ), সাইয়েদুনা আবূ বকর (رضي الله عنه) ও সাইয়েদুনা উমর ফারূক (رضي الله عنه)-এর মোবারক রওযাগুলো, যেগুলো নির্মিত হয়েছিল বহু শতাব্দী আগে। জেরুসালেমে বায়তুল আকসা’র গুম্বজটি মুসলমানদের জন্যে তৃতীয় সর্বাধিক পবিত্র স্থান। অথচ এতে শুধু রয়েছে মহানবী (ﷺ)-এর কদম মোবারকের চিহ্ন, যেখান থেকে তিনি মে’রাজে গমন করেন!



বায়তুল মোকাদ্দসের এই সুপ্রাচীন গুম্বজসম্বলিত ইসলামী ইমারতটি এখন হুমকির মুখোমুখি, কারণ ওহাবী মতবাদ অনুযায়ী এ ধরনের ইমারত মন্দ বেদআত (উদ্ভাবন)। মে’রাজের গুম্বজটি এর পাশেই অবস্থিত, যেখান থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঊর্ধ্বগমন শুরু করেন। ওহাবী মতে, পবিত্র স্থানে এ ধরনের গুম্বজ নির্মাণ ও একে গুরুত্ব প্রদান মন্দ একটি বেদআত এবং তারা শেরকের ভয়ে এটি বুলডজার দিয়ে ধূলিসাৎ করা সমীচীন মনে করে। ইসলামের শত্রুদের শুধু ওহাবী মতাবলম্বীদের হাতে ক্ষমতা দেয়াই বাকি, যা দ্বারা ওহাবীরা মে’রাজের গুম্বজসহ সকল বিদ্যমান ইসলামী ঐতিহ্যবাহী স্থানকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেবে।



যমযম কুয়ার ওপরে গুম্বজ নির্মিত হয় ইসলামের প্রাথমিক যুগে, খলীফা আল-মনসূরের শাসনামলে (১৪৯ হিজরী)। ওহাবী মতবাদ অনুসারে এটিও মন্দ বেদআত ও শেরেকী কর্ম হবার কথা। তাদের কুপ্রথানুযায়ী পৃথিবীতে ঐতিহ্যবাহী আল্লাহর শ’আয়ের তথা স্মারক চিহ্নের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা শেরেকের পর্যায়ভুক্ত হবে। অথচ এই ফেরকাহ’র স্ববিরোধিতার চূড়ান্ত নিদর্শনস্বরূপ খোদায়ী আশীর্বাদধন্য যমযম কুয়ার ওপর ওহাবী-সমর্থক সউদী রাজা-বাদশাহবর্গ-ই ইমারত নির্মাণ করে দিয়েছে।



এক্ষণে আমরা চিরতরে ওপরে উদ্ধৃত ওহাবীদের অপযুক্তির মূলোৎপাটন করবো, এমন কি কবরে আস্তর করা, ওর ওপরে ’মাকতাব’ স্থাপন, বা কবরের ধারে বসার বিষয়গুলোও এতে অন্তর্ভুক্ত হবে। হাদীসশাস্ত্রে ইচ্ছাকৃতভাবে হাদীস জাল করা এবং কোনো রওয়ায়াতের প্রথমাংশ সম্পর্কে স্পষ্ট ব্যাখ্যাকারী বাকি অংশগুলোর গোপনকারী হিসেবে ওহাবীদের কুখ্যাতি আছে। কবর আস্তর না করার পক্ষে হাদীস উদ্ধৃত করার পরে আপনারা কোনো ওহাবীকেই কখনো দেখবেন না ইমাম তিরমিযী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) ও ইমাম হাকিম (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর এতদসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বর্ণনা করতে। পক্ষান্তরে, আমাদের সুন্নীপন্থী ইসলাম ’আওয়ামুন্ নাস’ তথা সর্বসাধারণের সামনে পুরো চিত্রটুকু তুলে ধরতেই আমাদেরকে আদেশ করে, যাতে তাঁরা বুঝতে সক্ষম হন কেন হযরত হাসান আল-বসরী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি), ইমাম শাফেঈ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) ও ইমাম হাকিম (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর মতো সর্বোচ্চ পর্যায়ের মেধাসম্পন্ন মোহাদ্দেসীনবৃন্দ এই সব হাদীসকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করেননি।



’কবরে আস্তর না করা, না লেখা বা বসা’ সংক্রান্ত হাদীসটি বর্ণনার পরে ইমাম তিরমিযী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন: “এই হাদীসটি হাসান সহীহ এবং এটি বিভিন্ন সনদ বা সূত্রে হযরত জাবের (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত হয়েছে। কিছু উলেমা (কাদা) মাটি দ্বারা কবর আস্তর করার অনুমতি দিয়েছেন; এঁদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম হাসান আল-বসরী (আমীরুল মো’মেনেীন ফীল্ হাদীস)। অধিকন্তু, ইমাম শাফেঈ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) কাদামাটি দ্বারা কবর আস্তর করাতে কোনো ক্ষতি দেখতে পাননি।” 
[সুনানে তিরমিযী, কবর আস্তর না করার হাদীস  #১০৫২]



ওহাবীরা তবুও অজুহাত দেখাবে যে ইমাম তিরমিযী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) তো কাদামাটি দিয়ে কবর আস্তর করতে বলেছিলেন, সিমেন্ট দিয়ে করতে বলেননি। এমতাবস্থায় এর উত্তর দিয়েছেন ইমাম আল-হাকিম (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি), যিনি অনুরূপ আহাদীস বর্ণনার পরে বলেন: “এ সকল আসানীদ (সনদ) সহীহ, কিন্তু পূর্ব হতে পশ্চিম পর্যন্ত মুসলমান জ্ঞান বিশারদগণ এগুলো আমল বা অনুশীলন করেননি। কবরের ওপরে ফলকে লেখা মুসলমানদের পরবর্তী প্রজন্ম ‘সালাফ’বৃন্দ থেকেই গ্রহণ করেছিলেন।
 [’মোস্তাদরাক-এ-হাকিম’, ১:৩৭০, হাদীস #১৩৭০]



সুতরাং এতোজন ইসলামী বিদ্বান এই মত পোষণ করার দরুন প্রমাণিত হয় যে ওহাবীরা যেভাবে উক্ত হাদীসগুলোকে বুঝে থাকে, প্রকৃতপক্ষে সেগুলো সেই অর্থজ্ঞাপক নয়। মনে রাখা জরুরি যে, এই মহান মোহাদ্দেসীনবৃন্দ ওহাবীদের মনগড়া চিন্তাভাবনা থেকে আরও ভালভাবে হাদীসশাস্ত্র সম্পর্কে জানতেন এবং বুঝতেন।



হযরত আম্বিয়া (আ:)-এর মাযার-রওযা আস্তর করার বৈধতা প্রমাণকারী রওয়ায়াতটি হযরত আবূ আইয়ুব আনসারী (رضي الله عنه) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে; তিনি বলেন: “আমি মহানবী (ﷺ)-এর কাছে এসেছি, পাথরের কাছে নয়” [মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল, হাদীস # ২৩৪৭৬]। ইমাম আল-হাকিম (رضي الله عنه)-ও এটি বর্ণনা করে এর সনদকে সহীহ বলেছেন; তিনি বলেন, “আয্ যাহাবীও তাঁর (ইমাম আহমদের) তাসহিহ-এর সাথে একমত হয়েছেন এবং একে সহীহ বলেছেন।”
 [’মোস্তাদরাক আল-হাকিম’, আয্ যাহাবীর তালখীস সহকারে, ৪:৫৬০, হাদীস # ৮৫৭১]



এই রওয়ায়াত প্রমাণ করে যে নবী পাক (ﷺ)-এর রওযা মোবারক আস্তরকৃত ছিল, নতুবা হযরত আবূ আইয়ুব আনসারী (رضي الله عنه) স্বৈরশাসক মারওয়ানকে খণ্ডন করার সময় ‘পাথর’ শব্দটি ব্যবহার করতেন না। এই আনসার সাহাবী (رضي الله عنه)-এর রওয়ায়াতটি হযরতে সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-এর আকীদা-বিশ্বাস ও মারওয়ানের মতো স্বৈরশাসকদের ভ্রান্ত ধারণার পার্থক্যও ফুটিয়ে তোলে (অনুরূপভাবে আমাদের পবিত্র স্থানগুলোও ওহাবীদের মতো স্বৈরশাসক জবরদখল করে রেখেছে, যা তাদের ন্যায়পরায়ণতা সাব্যস্ত করে না; কারণ ইতিপূর্বেও মক্কা মোয়াযযমা ও মদীনা মোনাওয়ারা এয়াযীদ, হাজ্জাজ বিন ইউসূফ, মারওয়ানের মতো জালেমদের অধীনে ছিল)। মহানবী (ﷺ)-এর পবিত্র রওযায় কাউকে মুখ ঘষতে দেখে মারওয়ান হতভম্ব হয়েছিল। সে যখন বুঝতে পারে এই ব্যক্তি-ই সাহাবী হযরত আবূ আইয়ুব আল-আনসারী (رضي الله عنه), তখন একেবারেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়।



ওহাবীরা অপর যে বিষয়টির অপব্যবহার করে, তা হলো কবরের ধারে বসা। এ প্রসঙ্গে ইমাম মালেক (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) প্রণীত ‘মুওয়াত্তা’ গ্রন্থে একটি চমৎকার হাদীস বর্ণিত হয়েছে, আর এতে ইমাম মালেক (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর নিজেরও একটি চূড়ান্ত মীমাংসাকারী সিদ্ধান্ত বিদ্যমান, যা প্রমাণ করে যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সার্বিকভাবে মানুষদেরকে কবরের ধারে বসতে নিষেধ করেননি, বরং পেশাব-মলত্যাগ করতে নিষেধ করেছিলেন; কেননা, ’তা আক্ষরিক অর্থেই কবরবাসীর ক্ষতি করে।’ এই সব হাদীসে ব্যবহৃত ‘আ’লা’ (ওপরে) শব্দটি ইচ্ছাকৃতভাবে ওহাবীরা ভুল বুঝে থাকে, যাতে তাদের ধোকাবাজীর প্রসার ঘটানো যায়।



ইমাম মালেক (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) নিম্নবর্ণিত শিরোনামে গোটা একখানা অধ্যায় বরাদ্দ করেছেন:



”জানাযার জন্যে থামা এবং কবরস্থানের পাশে বসা”  



ওপরে উক্ত অধ্যায়ে বর্ণিত দ্বিতীয় রওয়ায়াতে বিবৃত হয়: “এয়াহইয়া (رضي الله عنه) আমার (ইমাম মালেকের) কাছে বর্ণনা করেন মালেক (رضي الله عنه) হতে, যিনি শুনেছিলেন এই মর্মে যে, হযরত আলী ইবনে আবি তালেব (رضي الله عنه) কবরে মাথা রেখে পাশে শুয়ে থাকতেন। মালেক (رضي الله عنه) বলেন, ‘আমরা যা দেখেছি, কবরের ধারে পেশাব-মলত্যাগ করার ক্ষেত্রেই কেবল নিষেধ করা হয়েছে’।”
 [’মুওয়াত্তা-এ-ইমাম মালেক’, ১৬তম বই, অধ্যায় # ১১, হাদীস # ৩৪] 



মনে রাখা জরুরি, অনেক ইসলামী পণ্ডিতের মতে বোখারী শরীফ হতে ইমাম মালেক(رضي الله عنه)-এর ’মুওয়াত্তা’ গ্রন্থটি অধিক কর্তৃত্বসম্পন্ন।



কুরআন মজীদে যেমন এরশাদ হয়েছে: “আল্লাহ তা (কুরআন মজীদ) দ্বারা অনেককে গোমরাহ (পথভ্রষ্ট) করেন এবং অনেককে হেদায়াত (পথপ্রদর্শন) করেন।” 
[আল-কুরআন, ২:২৬]



যদি কুরআন মজীদ পাঠ করে মানুষেরা গোমরাহ হতে পারে (যেমনটি হয়েছে ওহাবীরা), তাহলে একইভাবে হাদীস শরীফও যথাযথভাবে বিশেষজ্ঞদের অধীনে পাঠগ্রহণ না করে অধ্যয়নের চেষ্টা করলে তা দ্বারা মানুষজন পথভ্রষ্ট হতে পারে।



এ কারণেই মহান সালাফ আস্ সালেহীন (প্রাথমিক যুগের পুণ্যাত্মাবৃন্দ) ইমাম সুফিয়ান ইবনে উবায়না (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) ও ইবনে ওহাব (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) কী সুন্দর বলেছেন:



সুফিয়ান ইবনে উবায়না (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, “হাদীসশাস্ত্র পথভ্রষ্টতা, ফকীহমণ্ডলীর মধ্যস্থতা ব্যতিরেকে।” 



ইবনে ওহাব (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, “হাদীসশাস্ত্র গোমরাহী, উলেমাবৃন্দের মধ্যস্থতা ব্যতিরেকে।” [দ্বিতীয় উদ্ধৃতিটি ইমাম কাজী আয়ায কৃত ‘তারতীব আল-মাদারিব’ গ্রন্থের ২৮ পৃষ্ঠায় বিদ্যমান]

অধিকন্তু, ইমাম আবূ হানিফা (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-কে একবার বলা হয়, ‘অমুক মসজিদে তমুক এক দল আছে যারা ফেকাহ (ইসলাম ধর্মশাস্ত্র সম্পর্কিত সূক্ষ্ম জ্ঞান) বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করে।’ তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘তাদের কি কোনো শিক্ষক আছে?’ উত্তরে বলা হয়, ‘না।’ এমতাবস্থায় হযরত ইমাম (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, ‘তাহলে তারা কখনোই এটি বুঝতে সক্ষম হবে না।’ [ইবনে মুফলিহ রচিত ‘আল-আদাব আশ্ শরিয়াহ ওয়াল্ মিনাহ আল-মারিয়া’, ৩ খণ্ডে প্রকাশিত, কায়রোতে পুনর্মুদ্রিত সংস্করণ, মাকতাবা ইবনে তাইমিয়া, কায়রো, ১৩৯৮ হিজরী/১৯৭৮ খৃষ্টাব্দ, ৩:৩৭৪]



অতএব, এক্ষণে ওহাবীদের পথভ্রষ্টতা সম্পর্কে ভাবুন, যাদের হাদীসশাস্ত্র-বিষয়ক প্রধান হর্তাকর্তা নাসের আদ্ দালালাহ মানে আলবানীর এই শাস্ত্রে কোনো এজাযা ও স্তর-ই নেই; ঘুরে ঘুরে ফতোয়াদাতা সাধারণ ‘সালাফী’দের কথা তো বহু দূরেই রইলো!



দলিল নং - ২ 



মহান হানাফী আলেম মোল্লা আলী কারী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)তাঁর চমৎকার ’মিরকাত শরহে মিশকাত’ গ্রন্থে লেখেন: “সালাফ তথা প্রাথমিক যুগের মুসলমানগণ প্রখ্যাত মাশায়েখ (পীর-বোযর্গ) ও হক্কানী উলেমাবৃন্দের মাযার-রওযা নির্মাণকে মোবাহ, অর্থাৎ, জায়েয (অনুমতিপ্রাপ্ত) বিবেচনা করেছেন, যাতে মানুষেরা তাঁদের যেয়ারত করতে পারেন এবং সেখানে (সহজে) বসতে পারেন।” 
[মিরকাত শরহে মিশকাত, ৪র্থ খণ্ড, ৬৯ পৃষ্ঠা]



মহান শাফেঈ আলেম ও সূফী ইমাম আব্দুল ওয়াহহাব শারানী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) লেখেন: “আমার শিক্ষক আলী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) ও ভাই আফযালউদ্দীন (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) সাধারণ মানুষের কবরের ওপরে গুম্বজ নির্মাণ ও কফিনে মৃতদের দাফন এবং (সাধারণ মানুষের) কবরের ওপরে চাদর বিছানোকে নিষেধ করতেন। তাঁরা সব সময়-ই বলতেন, গুম্বজ ও চাদর চড়ানোর যোগ্য একমাত্র আম্বিয়া (আ:) ও মহান আউলিয়া (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-বৃন্দ। অথচ, আমরা মনুষ্য সমাজের প্রথার বন্ধনেই রয়েছি আবদ্ধ।” [আল-আনওয়ারুল কুদসিয়্যা, ৫৯৩ পৃষ্ঠা]



দলিল নং - ৩ 



হযরত দাউদ ইবনে আবি সালেহ হতে বর্ণিত; তিনি বলেন: “একদিন মারওয়ান (মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের রওযা মোবারকে) এসে দেখে, এক ব্যক্তি রওযা শরীফের খুব কাছাকাছি মুখ রেখে মাটিতে শুয়ে আছেন। মারওয়ান তাঁকে বলে, ‘জানো তুমি কী করছো?’ সে তাঁর দিকে এগিয়ে গেলে সাহাবী হযরত খালেদ বিন যাঈদ আবূ আইয়ুব আল-আনসারী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-কে দেখতে পায়। তিনি (সাহাবী)(رضي الله عنه) জবাবে বলেন, ‘হ্যাঁ (আমি জানি); আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে (দর্শনার্থী হতে) এসেছি, কোনো পাথরের কাছে আসি নি। আমি মহানবী (ﷺ)-এর কাছে শুনেছি, (ধর্মের) অভিভাবক যোগ্য হলে ধর্মের ব্যাপারে কাঁদতে না; তবে হ্যাঁ, অভিভাবক অযোগ্য হলে ধর্মের ব্যাপারে কেঁদো।”



রেফারেন্স/সূত্র



* আল-হাকিম এই বর্ণনাকে সহীহ বলেছেন; অপরদিকে, আয্ যাহাবীও তাঁর সত্যায়নের সাথে একমত হয়েছেন। [হাকিম, আল-মোস্তাদরাক, ৪র্থ খণ্ড, হাদীস নং ৫১৫]



* ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-ও তাঁর ’মুসনাদ’ গ্রন্থের ৫ম খণ্ডে সহীহ সনদে এটি বর্ণনা করেন। [হাদীস নং ৪২২]



এবার আমরা মাযার যেয়ারত এবং সেখানে কুরআন তেলাওয়াত ও যিকর-আযকার পালনের ব্যাপারে আলোচনায় প্রবৃত্ত হবো। হযরত আম্বিয়া কেরাম (আ:) ও আউলিয়া (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-বৃন্দের মাযার-রওযা যেয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করার পক্ষে আদেশসম্বলিত মহানবী (ﷺ) হতে সরাসরি একখানা ’নস’ তথা হাদীস শরীফ এক্ষেত্রে বিদ্যমান, যা বোখারী শরীফে লিপিবদ্ধ আছে।



বোখারী শরীফ, ২য় খণ্ড, বই নং ২৩, হাদীস নং ৪২৩



হুযূর পাক (ﷺ) এরশাদ ফরমান: “আমি যদি সেখানে থাকতাম, তাহলে আমি তোমাদেরকে মূসা (আ:)-এর মাযারটি দেখাতাম, যেটি লাল বালির পাহাড়ের সন্নিকটে পথের ধারে অবস্থিত।”



এই হাদীস আবারও রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর কাছ থেকে একটি ‘নস’ (স্পষ্ট দলিল) এই মর্মে যে তিনি আম্বিয়া (আ:)-গণের মাযার-রওযা যেয়ারত পছন্দ করতেন; উপরন্ত, তিনি সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-এর কাছে জোরালোভাবে তা ব্যক্তও করেছেন।



উপলব্ধির জন্যে নিম্নে পেশকৃত হাদীসটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এটি মাযার-রওযা যেয়ারতের আদব পালনে সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-এর আকীদা-বিশ্বাসেরও প্রতিফলন করে।  



হযরত সাইয়্যেদাহ আয়েশা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন: “যে ঘরে মহানবী (ﷺ) ও আমার পিতা (আবূ বকর -(رضي الله عنه))-কে দাফন করা হয়, সেখানে যখন-ই আমি প্রবেশ করেছি, তখন আমার মাথা থেকে পর্দা সরিয়ে ফেলেছি এই ভেবে যে আমি যাঁদের যেয়ারতে এসেছি তাঁদের একজন আমার পিতা ও অপরজন আমার স্বামী। কিন্তু আল্লাহর নামে শপথ! যখন হযরত উমর ফারূক (رضي الله عنه) ওই ঘরে দাফন হলেন, তখন থেকে আমি আর কখনোই ওখানে পর্দা না করে প্রবেশ করি নি; আমি হযরত উমর (رضي الله عنه)-এর প্রতি লজ্জার কারণেই এ রকম করতাম।”
 [মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ২০২ পৃষ্ঠা, হাদীস # ২৫৭০১]



জরুরি জ্ঞাতব্য: প্রথমতঃ এই হাদীসে প্রমাণিত হয় যে শুধু আম্বিয়া (আ:)-এর মাযার-রওযা নির্মাণ-ই ইসলামে বৈধ নয়, পাশাপাশি সালেহীন তথা পুণ্যবান মুসলমানদের জন্যেও তা নির্মাণ করা বৈধ। লক্ষ্য করুন যে হাদীসে ‘বায়ত’ বা ‘ঘর’ শব্দটি উল্লেখিত হয়েছে। মানে মহানবী (ﷺ)-এর রওযা শরীফের সাথে সর্ব-হযরত আবূ বকর (رضي الله عنه) ও উমর (رضي الله عنه)-এর মাযার-রওযাও ‘একটি নির্মিত ঘরের অভ্যন্তরে’ অবস্থিত ছিল।



দ্বিতীয়তঃ হযরত উমর ফারূক (رضي الله عنه)-এর উক্ত ঘরে দাফনের পরে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (رضي الله عنه) পূর্ণ পর্দাসহ সেখানে যেয়ারতে যেতেন। এটি এতদসংক্রান্ত বিষয়ে হযরতে সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-এর আকীদা-বিশ্বাস প্রতিফলনকারী স্পষ্ট দলিল, যা’তে বোঝা যায় তাঁরা মাযারস্থদের দ্বারা যেয়ারতকারীদের চিনতে পারার ব্যাপারটিতে স্থির বিশ্বাস পোষণ করতেন। হাদীসটির স্পষ্ট বর্ণনার দিকে লক্ষ্য করুন। তাতে বলা হয়েছে ‘হায়া মিন উমর’, মানে হযরত উমর (رضي الله عنه)(-এর প্রতি লজ্জার কারণে হযরত আয়েশা ((رضي الله عنه) ওখানে পর্দা করতেন।



আমরা জানি, ওহাবীদের ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধে গেলে প্রতিটি সহীহ হাদীসকে অস্বীকার করা তাদের স্বভাবসিদ্ধ ব্যাপার। তারা অহরহ আলবানী (বেদআতী-গুরু)-এর হাওয়ালা দেয় নিজেদের যুক্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে; কিন্তু এক্ষেত্রে তারা তাদের ওই নেতারও শরণাপন্ন হতে পারছে না। কেননা, এই হাদীস এতোই বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য যে এমন কি আলবানীও এটিকে যয়ীফ বা দুর্বল ঘোষণা করতে পারেনি (নতুবা তার কুখ্যাতি ছিল বাঁকা পথে সহীহ হাদীসকে অস্বীকার করার, যখন-ই তা তার মতবাদের পরিপন্থী হতো)। এ কথা বলার পাশাপাশি আমরা এও স্পষ্ট করে বলতে চাই যে, শুধু ওহাবীরাই নয়, আলবানী-ও উসূলে হাদীস তথা হাদীসের নীতিমালাবিষয়ক শাস্ত্রে একেবারেই কাঁচা ছিল। আমরা কেবল তার উদ্ধৃতি দিয়েছি এই কারণে যাতে শত্রুদের মধ্য থেকেই সত্যের স্বীকৃতি পাওয়া যায়।



ইমাম নূরুদ্দীন হায়তামী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) এই হাদীসটি সম্পর্কে বলেন: “এটি ইমাম আহমদ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) কর্তৃক বর্ণিত এবং এর বর্ণনাকারীরা সবাই সহীহ মানব।” 
[মজমাউয্ যাওয়াইদ, ৯:৪০, হাদীস # ১২৭০৪]



ইমাম আল-হাকিম (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) এটি বর্ণনা করার পর বলেন, “এই হাদীস বোখারী ও মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী সহীহ।”
 [মোস্তাদরাক আল-হাকিম, হাদীস # ৪৪৫৮]



নাসিরুদ্দীন আলবানী আল-মোবতাদি আল-মাশহুর (কুখ্যাত বেদআতী) এই হাদীসকে মেশকাতুল মাসাবিহ গ্রন্থের ওপর নিজ ব্যাখ্যামূলক ‘তাখরিজ’পুস্তকে সমর্থন করেছে (# ১৭১২)। 



ইবনে কাসীর লিখেছে, “ইবনে আসাকির হযরত আমর ইবনে জামাহ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর জীবনীগ্রন্থে বর্ণনা করেন: ‘এক তরুণ বয়সী ব্যক্তি নামায পড়তে নিয়মিত মসজিদে আসতেন। একদিন এক নারী তাঁকে অসৎ উদ্দেশ্যে নিজ গৃহে আমন্ত্রণ করে। তিনি যখন ওই নারীর ঘরে ছিলেন, 
তখন তিনি উচ্চস্বরে তেলাওয়াত করেন কুরআনের আয়াত - 
নিশ্চয় ওই সব মানুষ যারা তাকওয়ার অধিকারী হন, যখন-ই তাদেরকে কোনো শয়তানী খেয়ালের ছোঁয়া স্পর্শ করে, তখন তারা সাবধান হয়ে যান; তৎক্ষণাৎ তাদের চোখ খুলে যায় (৭:২০১)
 অতঃপর তিনি মূর্ছা যান এবং আল্লাহর ভয়ে ইন্তেকাল করেন। মানুষেরা তাঁর জানাযার নামায পড়েন এবং তাঁকে দাফনও করেন। হযরত উমর (রা:) এমতাবস্থায় একদিন জিজ্ঞেস করেন, নিয়মিত মসজিদে নামায পড়ার জন্যে আগমনকারী ওই তরুণ কোথায়? মানুষেরা জবাব দেন, তিনি ইন্তেকাল করেছেন এবং আমরা তাঁকে দাফন করেছি। এ কথা শুনে হযরত উমর (রা:) ওই তরুণের কবরে যান এবং তাঁকে সম্ভাষণ জানিয়ে নিম্নের কুরআনের আয়াতটি তেলাওয়াত করেন - এবং যে ব্যক্তি আপন রবের সম্মুখে দণ্ডায়মান হওয়াকে ভয় করেন, তার জন্যে রয়েছে দুটি জান্নাত (৫৫:৪৬)। ওই তরুণ নিজ কবর থেকে জবাব দেন, নিশ্চয় আল্লাহ আমাকে দুটি জান্নাত দান করেছেন’।” 

[তাফসীরে ইবনে কাসীর, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ৪৯৬ পৃষ্ঠা, আল-কুরআন ৭:২০১-এর ব্যাখ্যায়]



[অনুবাদকের জ্ঞাতব্য: খলীফা উমর ফারূক (رضي الله عنه)-এর কাশফ বা দিব্যদৃষ্টির প্রমাণ এখানে পাওয়া যায়। তিনি ওই তরুণের ঘটনা কাশফ দ্বারা জানতেন। নতুবা তিনি কেন ’তাকওয়া-বিষয়ক আয়াত’ তেলাওয়াত করলেন? উপরন্তু, তিনি যে ‘কাশফুল কুবুর’ বা কবরবাসীর অবস্থা দিব্যদৃষ্টি দ্বারা জানতে পারতেন তাও এই ঘটনায় প্রমাণিত হয়।]



দলিল নং - ৪ 



হযরত আবূ হোরায়রা (رضي الله عنه)-এর সূত্রে বর্ণিত; মহানবী (ﷺ) এরশাদ ফরমান: “আমি নিজেকে ’হিজর’-এর মধ্যে পেলাম এবং কোরাইশ গোত্র আমাকে মে’রাজের রাতের ভ্রমণ সম্পর্কে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছিল। আমাকে বায়তুল মাকদিস সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন করা হয়, যা আমার স্মৃতিতে রক্ষিত ছিল না। এতে আমি পেরেশানগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম; এমন পর্যায়ের পেরেশানির মুখোমুখি ইতিপূর্বে কখনো-ই হই নি। অতঃপর আল্লাহ পাক এটিকে (বায়তুল মাকদিসকে) আমার চোখের সামনে মেলে ধরেন। আমি তখন এর দিকে তাকিয়ে তারা (কুরাইশবর্গ) যা যা প্রশ্ন করছিল সবগুলোরই উত্তর দেই। আমি ওই সময় আম্বিয়া (আ:)-বৃন্দের জমায়েতে নিজেকে দেখতে পাই। আমি হযরত মূসা (আ:)-কে নামায পড়তে দেখি। তিনি দেখতে সুদর্শন (সুঠাম দেহের অধিকারী) ছিলেন, যেন শানু’য়া গোত্রের কোনো পুরুষ। আমি মরিয়ম তনয় ঈসা মসীহ (আ:)-কে দেখি নামায আদায় করতে; সকল মানবের মাঝে তাঁর (চেহারার) সবচেয়ে বেশি সাযুজ্য হলো উরওয়া ইবনে মাস’উদ আস্ সাকাফী (رضي الله عنه)-এর সাথে। আমি হযরত ইবরাহীম (আ:)-কেও সালাত আদায় করতে দেখি; মানুষের মাঝে তাঁর (চেহারার) সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্য হলো তোমাদের সাথী (মহানবী স্বয়ং)-এর সাথে। নামাযের সময় হলে পরে আমি তাতে ইমামতি করি। নামাযশেষে কেউ একজন বল্লেন, ‘এই হলেন মালেক (ফেরেশতা), জাহান্নামের রক্ষণাবেক্ষণকারী; তাঁকে সালাম জানান।’ আমি তাঁর দিকে ফিরতেই তিনি আমার আগে (আমাকে) সালাম জানান।” 
[সহীহ মুসলিম, ১ম খণ্ড, হাদীস নং ৩২৮; ইমাম হাফেয ইবনে হাজর আসকালানী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-ও এটিকে নিজ ‘ফাতহুল বারী’ গ্রন্থের ৬ষ্ঠ খণ্ডের ৪৮৩ পৃষ্ঠায় সমর্থন দিয়েছেন]



হযরত মূসা (আ:) ও অন্যান্য আম্বিয়া (আ:)-বৃন্দ তাঁদের মাযার-রওযায় জীবিতাবস্থায় বর্তমান   



হযরত আনাস বিন মালেক (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীস, যিনি বলেন: “আমি আগমন করি”; আর হযরত হাদ্দিব (رضي الله عنه) -এর বর্ণনায় হাদীসের কথাগুলো ছিল এ রকম - “মে’রাজ রজনীতে ভ্রমণের সময় আমি লাল টিলার সন্নিকটে হযরত মূসা (আ:)-কে অতিক্রমকালে তাঁকে তাঁর রওযা শরীফে নামায আদায়রত অবস্থায় দেখতে পাই। 
[সহীহ মুসলিম, বই নং ৩০, হাদীস নং - ৫৮৫৮]



ইমাম সৈয়ুতী (رضي الله عنه)



আম্বিয়া (আ:)-এর মাযার-রওযায় তাঁদের রূহানী হায়াত সম্পর্কে হযরত ইমাম সৈয়ুতী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন: “রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর রওযা মোবারকে তাঁর রূহানী জীবন এবং অন্যান্য আম্বিয়া (আ:)-বৃন্দের নিজ নিজ মাযার-রওযায় অনুরূপ জীবন সম্পর্কে যে জ্ঞান আমরা লাভ করেছি তা ‘চূড়ান্ত জ্ঞান’ (এলমান কাতে’য়্যান)। এগুলোর প্রমাণ হচ্ছে ‘তাওয়াতুর’ (সর্বত্র জনশ্রুতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত)। ইমাম বায়হাকী (رضي الله عنه) আম্বিয়া (আ:)-বৃন্দের মাযার-রওযায় তাঁদের পরকালীন জীবন সম্পর্কে একটি ’জুয’ (আলাদা অংশ/অধ্যায়) লিখেছেন। তাতে প্রদত্ত প্রমাণাদির মধ্যে রয়েছে যেমন,

 ১/ - সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত আনাস ইবনে মালেক (رضي الله عنه) বর্ণিত একটি হাদীসে হুযূর পূর নূর (ﷺ) এরশাদ ফরমান, ’মে’রাজ রাতে আমি হযরত মূসা (আ:)-এর (রওযার) পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম এবং ওই সময় তাঁকে দেখতে পাই তিনি তাঁর মাযারে সালাত আদায় করছিলেন’;

 ২/ - আবূ নুয়াইম নিজ ‘হিলইয়া’ পুস্তকে হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে একটি বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন, যা’তে ওই সাহাবী রাসূলে খোদা (ﷺ)-কে বলতে শোনেন, ’আমি হযরত মূসা (আ:)-এর (রওযার) পাশ দিয়ে যাবার সময় তাঁকে নামাযে দণ্ডায়মান দেখতে পাই’; 

৩/ - আবূ ইয়ালার ‘মুসনাদ’ গ্রন্থে ও ইমাম বায়হাকী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর ‘হায়াত আল-আম্বিয়া’ পুস্তকে হযরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে যে নবী করীম (ﷺ) এরশাদ ফরমান: ’আম্বিয়া (আ:) তাঁদের মাযার-রওযায় জীবিত আছেন এবং তাঁরা (সেখানে) সালাত আদায় করেন’।” 
[ইমাম সৈয়ুতী কৃত ‘আল-হাওয়ী লিল্ ফাতাউইয়ী’, ২য় খণ্ড, ২৬৪ পৃষ্ঠা]



ইমাম হায়তামী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) ওপরে বর্ণিত সর্বশেষ হাদীস সম্পর্কে বলেন, “আবূ ইয়ালা ও বাযযার এটি বর্ণনা করেছেন এবং আবূ ইয়ালার এসনাদে সকল বর্ণনাকারী-ই আস্থাভাজন।” ইমাম হাফেয ইবনে হাজর আসকালানী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-ও এই রওয়ায়াতকে সমর্থন দিয়েছেন নিজ ‘ফাতহুল বারী’ গ্রন্থের ৬ষ্ঠ খণ্ডের ৪৮৩ পৃষ্ঠায়। [কাদিমী কুতুবখানা সংস্করণের ৬০২-৬০৩ পৃষ্ঠায়]



দলিল নং - ৫    



ইমাম কুরতুবী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) হযরত আবূ সাদেক (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন যে ইমাম আলী (رضي الله عنه) বলেন, “মহানবী (ﷺ)-এর বেসালের (পরলোকে আল্লাহর সাথে মিলিত হবার) তিন দিন পর জনৈক আরব এসে তাঁর রওযা মোবারকের ওপর পড়ে যান এবং তা থেকে মাটি নিয়ে মাথায় মাখতে থাকেন। তিনি আরয করেন, ‘এয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! আপনি বলেছিলেন আর আমরাও শুনেছিলাম, আপনি আল্লাহর কাছ থেকে জেনেছিলেন আর আমরাও আপনার কাছ থেকে জেনেছিলাম; আপনার কাছে আল্লাহর প্রেরিত দানগুলোর মধ্যে ছিল তাঁর-ই পাক কালাম - আর যদি কখনো তারা (মো’মেনগণ) নিজেদের আত্মার প্রতি যুলুম করে, তখন হে মাহবুব, তারা আপনার দরবারে হাজির হয় এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, আর রাসূল (ﷺ)-ও তাদের পক্ষে সুপারিশ করেন, তবে অবশ্যই তারা আল্লাহকে অত্যন্ত তওবা কবুলকারী, দয়ালু হিসেবে পাবে (আল-কুরআন, ৪:৬৪)। আমি একজন পাপী, আর এক্ষণে আপনার-ই দরবারে আগত, যাতে আপনার সুপারিশ আমি পেতে পারি।’ এই আরযির পরিপ্রেক্ষিতে রওযা মোবারক থেকে জবাব এলো, ‘কোনো সন্দেহ-ই নেই তুমি ক্ষমাপ্রাপ্ত!’ 
[তাফসীরে কুরতুবী, আল-জামে’ লি আহকাম-ইল কুরআন, ৬ষ্ঠ খণ্ড, উক্ত আল-কুরআনের ৪:৬৪-এর তাফসীর]


জ্ঞাতব্য: এটি সমর্থনসূচক দলিল হিসেবে উদ্ধৃত।



দলিল নং - ৬ [ঈমানদারদের মা হযরত আয়েশা  সিদ্দিকা (رضي الله عنه) হতে প্রমাণ] 



ইমাম দারিমী বর্ণনা করেন হযরত আবূল জাওযা’ আউস ইবনে আব্দিল্লাহ (رضي الله عنه) হতে, ‍যিনি বলেন: মদীনাবাসীগণ একবার দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েন। তাঁরা মা আয়েশা (رضي الله عنه)-এর কাছে এ (শোচনীয় অবস্থার) ব্যাপারে ফরিয়াদ করেন। তিনি তাঁদেরকে মহানবী (দ:)-এর রওযা শরীফে গিয়ে ওর ছাদে একটি ছিদ্র করতে বলেন এবং রওযা পাক ও আকাশের মাঝে কোনো বাধা না রাখতে নির্দেশ দেন। তাঁরা তা-ই করেন। অতঃপর মুষলধারে বৃষ্টি নামে। এতে সর্বত্র সবুজ ঘাস জন্মায় এবং উট হৃষ্টপুষ্ট হয়ে মনে হয় যেন চর্বিতে ফেটে পড়বে। এই বছরটিকে ‘প্রাচুর্যের বছর’ বলা হয়। 
[সুনানে দারিমী, ১ম খণ্ড, ২২৭ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ৯৩]

রেফারেন্স:--

শায়খ মোহাম্মদ বিন আলাউইয়ী মালেকী (মক্কা শরীফ) বলেন, “এই রওয়ায়াতের এসনাদ ভাল; বরঞ্চ, আমার মতে, এটি সহীহ (বিশুদ্ধ)। উলেমাবৃন্দ এর নির্ভরযোগ্যতার বিষয়টি সমর্থন করেছেন এবং প্রায় সমকক্ষ বিশ্বস্ত প্রামাণিক দলিল দ্বারা এর খাঁটি হবার বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করেছেন।” 
[শেফা’উল ফু’য়াদ বি-যেয়ারতে খায়রিল এ’বাদ, ১৫৩ পৃষ্ঠা]



ইবনে আল-জাওযী, আল-ওয়াফা’ বি-আহওয়ালিল্ মোস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) [২:৮০১]



ইমাম তাকিউদ্দীন সুবকী (رضي الله عنه) কৃত ‘শেফাউস্ সেকাম ফী যেয়ারাতে খায়রিল আনাম’ [১২৮ পৃষ্ঠা]



ইমাম কসতলানী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) প্রণীত ‘আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়াহ’ [৪:২৭৬]; এবং ইমাম যুরকানী মালেকী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) ‘শরহে মাওয়াহিব’ [১১:১৫০]



সনদ: “আবূ নুয়াইম এই বর্ণনা শুনেছিলেন সাঈদ ইবনে যায়দ হতে; তিনি আ’মর ইবনে মালেক আল-নুকরী হতে; তিনি হযরত আবূল জাওযা আউস্ বিন আবদিল্লাহ (رضي الله عنه) হতে, যিনি এটি বর্ণনা করেন।



দলিল নং - ৭ 



হযরত আবূ হোরায়রা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে মহানবী (ﷺ) এরশাদ ফরমান, কেউ আমাকে সালাম জানালে আল্লাহ আমার রূহকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেন এবং আমি তার সালামের প্রত্যুত্তর দেই। 
[আবূ দাউদ শরীফ, ৪র্থ বই, হাদীস নং ২০৩৬]



ইমাম নববী (رضي الله عنه) এ হাদীস সম্পর্কে বলেন, “আবূ দাউদ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) এটি সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন।”
 [রিয়াযুস্ সালেহীন, ১:২৫৫, হাদীস # ১৪০২]



গায়রে মুকাল্লিদীন তথা লা-মযহাবী (আহলে হাদীস/’সালাফী’) গোষ্ঠীর নেতা কাজী শওকানী এই হাদীস বর্ণনার আগে বলে, “এটি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) ও ইমাম আবূ দাউদ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) সহীহ এবং মারফু’ সনদে হযরত আবূ হোরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন।”
 [নায়ল আল-আওতার, ৫:১৬৪]



দলিল নং - ৮ 



হযরত আবূদ্ দারদা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত; মহানবী (ﷺ) এরশাদ ফরমান: “শুক্রবার দিন আমার প্রতি অগণিত সালাওয়াত পাঠ করো, কেননা তার সাক্ষ্য বহন করা হবে। ফেরেশতাকুল এর খেদমতে উপস্থিত থাকবেন। কেউ সালাওয়াত পাঠ আরম্ভ করলে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমার কাছে পেশ হতে থাকবে।” আমি (আবূদ্ দারদা) জিজ্ঞেস করলাম তাঁর বেসালপ্রাপ্তির পরও কি তা জারি থাকবে। তিনি জবাবে বল্লেন: “আল্লাহ পাক আম্বিয়া (আ:)-এর মোবারক শরীরকে মাটির জন্যে হারাম করে দিয়েছেন। তাঁরা তাঁদের মাযার-রওযায় জীবিতাস্থায় আছেন এবং সেখানে তাঁরা রিযক-ও পেয়ে থাকেন।”



রেফারেন্স   



* হযরত আবূদ্ দারদা (رضي الله عنه) বর্ণিত ও তিরমিযী শরীফে লিপিবদ্ধ;  হাদীস নং ১৩৬৬



* সুনানে ইবনে মাজাহ, ১ম খণ্ড, হাদীস নং ১৬২৬



* আবূ দাউদ শরীফ, ২য় খণ্ড, হাদীস নং ১৫২৬



দলিল নং - ৯



ইমাম যাহাবী বর্ণনা করেন: একবার সমরকন্দ অঞ্চলে খরা দেখা দেয়। মানুষজন যথাসাধ্য চেষ্টা করেন; কেউ কেউ সালাত আল-এস্তেসক্কা (বৃষ্টির জন্যে নামায-দোয়া) পড়েন, কিন্তু তাও বৃষ্টি নামে নি। এমতাবস্থায় সালেহ নামের এক প্রসিদ্ধ নেককার ব্যক্তি শহরের কাজী (বিচারক)-এর কাছে উপস্থিত হন এবং বলেন, আমার মতে আপনার এবং মুসলমান সর্বসাধারণের ইমাম বোখারী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর মাযার শরীফ যেয়ারত করা উচিত। তাঁর মাযার শরীফ খারতাংক এলাকায় অবস্থিত। ওখানে মাযারের কাছে গিয়ে বৃষ্টি চাইলে আল্লাহ হয়তো বৃষ্টি মঞ্জুর করতেও পারেন।অতঃপর বিচারক ওই পুণ্যবান ব্যক্তির পরামর্শে সায় দেন এবং মানুষজনকে সাথে নিয়ে ইমাম সাহেব (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর মাযারে যান। সেখানে (মাযারে) বিচারক সবাইকে সাথে নিয়ে একটি দোয়া পাঠ করেন; এ সময় মানুষেরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন এবং ইমাম সাহেব (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-কে দোয়ার মধ্যে অসীলা হিসেবে গ্রহণ করেন। আর অমনি আল্লাহতা’লা মেঘমালা পাঠিয়ে ভারি বর্ষণ অবতীর্ণ করেন। সবাই খারতাংক এলাকায় ৭ দিন যাবত অবস্থান করেন এবং তাঁদের কেউই সামারকান্দ ফিরে যেতে চাননি। অথচ এই দুটি স্থানের দূরত্ব মাত্র ৩ মাইল।
 [ইমাম যাহাবী কৃত সিয়্যার আল-আ’লম ওয়ান্ নুবালাহ, ১২তম খণ্ড, ৪৬৯ পৃষ্ঠা]



জ্ঞাতব্য: এটি সমর্থনসূচক দলিল হিসেবে এখানে উদ্ধৃত। 



দলিল নং - ১০



ইমাম ইবনুল হাজ্জ্ব (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন: সালেহীন তথা পুণ্যবানদের মাযার-রওযা হতে বরকত আদায় (আশীর্বাদ লাভ) করার লক্ষ্যে যেয়ারত করতে বলা হয়েছে। কেননা, বুযূর্গদের হায়াতে জিন্দেগীর সময় যে বরকত আদায় করা যেতো, তা তাঁদের বেসালের পরও লাভ করা যায়। উলেমাবৃন্দ ও মোহাক্কিক্কীন (খোদার নৈকট্যপ্রাপ্তজন) এই রীতি অনুসরণ করতেন যে তাঁরা আউলিয়াবৃন্দের মাযার-রওযা যেয়ারত করে তাঁদের শাফায়াত (সুপারিশ) কামনা করতেন......কারো কোনো হাজত বা প্রয়োজন থাকলে তার উচিত আউলিয়া কেরামের মাযার-রওযা যেয়ারত করে তাঁদেরকে অসীলা করা। আর এ কাজে (বাধা দিতে) এই যুক্তি দেখানো উচিত নয় যে মহানবী (ﷺ) তিনটি মসজিদ (মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী ও মসজিদে আকসা) ছাড়া অন্য কোথাও সফর করতে নিষেধ করেছিলেন। মহান ইমাম আবূ হামীদ আল-গাযযালী (رضي الله عنه) নিজ ‘এহইয়া’ পুস্তকের ’আদাব আস্ সফর’ অধ্যায়ে উল্লেখ করেন যে হজ্জ্ব ও জেহাদের মতো এবাদতগুলোর ক্ষেত্রে সফর করা বাধ্যতামূলক। অতঃপর তিনি বলেন, ‘এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে আম্বিয়া (আ:), সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)), তাবেঈন (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) ও সকল আউলিয়া ও হক্কানী উলেমাবৃন্দের মাযার-রওযা যেয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর। যাঁর কাছে তাঁর যাহেরী জীবদ্দশায় সাহায্য চাওয়া জায়েয ছিল, তাঁর কাছে তাঁর বেসালের পরও (যেয়ারত করে) সাহায্য চাওয়া জায়েয’। 
[ইমাম ইবনুল হাজ্জ্ব প্রণীত আল-মাদখাল, ১ম খণ্ড, ২১৬ পৃষ্ঠা]



ইমাম আবূ আবদিল্লাহ ইবনিল হাজ্জ্ব আল-মালেকী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) আউলিয়া ও সালেহীনবৃন্দের মাযার-রওযা যেয়ারত সম্পর্কে একটি সম্পূর্ণ অধ্যায় রচনা করেন। তাতে তিনি লেখেন: মুতা’লিম (শিক্ষার্থী)-দের উচিত আউলিয়া ও সালেহীনবৃন্দের সান্নিধ্যে যাওয়া; কেননা তাঁদের দেখা পাওয়াতে অন্তর জীবন লাভ করে, যেমনিভাবে বৃষ্টি দ্বারা মাটি উর্বর হয়। তাঁদের সন্দর্শন দ্বারা পাষাণ হৃদয়ও নরম বা বিগলিত হয়। কারণ তাঁরা আল্লাহ পাকেরই বরগাহে সর্বদা উপস্থিত থাকেন, যে মহাপ্রভু পরম করুণাময়। তিনি কখনােই তাঁদের এবাদত-বন্দেগী বা নিয়্যতকে প্রত্যাখ্যান করেন না, কিংবা যারা তাঁদের মাহফিলে হাজির হন ও তাঁদেরকে চিনতে পারেন এবং তাঁদেরকে ভালোবোসেন, তাদেরকেও প্রত্যাখ্যান করেন না। এটি এ কারণে যে তাঁরা হলেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর পরে রহমতস্বরূপ, যে রহমত আল্লাহ-ওয়ালাদের জন্যে অবারিত। অতএব, কেউ যদি এই গুণে গুণান্বিত হন, তাহলে সর্বসাধারণের উচিত ত্বরিত তাঁর কাছ থেকে বরকত আদায় করা। কেননা, যারা এই আল্লাহ-ওয়ালাদের দেখা পান, তারা এমন রহমত-বরকত, জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও স্মৃতিশক্তি লাভ করেন যা ব্যাখ্যার অতীত। আপনারা দেখবেন ওই একই মা’আনী দ্বারা যে কেউ অনেক মানুষকে জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও জযবা (ঐশী ভাব)-এর ক্ষেত্রে পূর্ণতা লাভ করতে দেখতে পাবেন। যে ব্যক্তি এই রহমত-বরকতকে শ্রদ্ধা বা সম্মান করেন, তিনি কখনোই তা থেকে দূরে থাকেন না (মানে বঞ্চিত হন না)। তবে শর্ত হলো এই যে, যাঁর সান্নিধ্য তলব করা হবে, তাঁকে অবশ্যই সুন্নাতের পায়রুবী করতে হবে এবং সুন্নাহ’কে হেফাযত তথা সমুন্নত রাখতে হবে; আর তা নিজের কর্মেও প্রতিফলিত করতে হবে।
 [ইবনুল হাজ্জ্ব রচিত আল-মাদখাল, ২য় খণ্ড, ১৩৯ পৃষ্ঠা]



দলিল নং - ১১ 



হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে হুযূর পূর নূর (ﷺ) এরশাদ ফরমান: “আমার বেসালপ্রাপ্তির পরে যে ব্যক্তি আমার রওযা মোবারক যেয়ারত করে, সে যেন আমার হায়াতে জিন্দেগীর সময়েই আমার দেখা পেল।”



রেফারেন্স



* আত্ তাবারানী, ২য় খণ্ড, হাদীস নং ৪০৬



* ইমাম বায়হাকী প্রণীত শু’য়াবুল ঈমান, ৩য় খণ্ড, হাদীস নং ৪৮৯



জ্ঞাতব্য: এই হাদীসটি হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه) কর্তৃক বর্ণিত হলেও এর এসনাদে বর্ণনাকারীরা একেবারেই ভিন্ন; আর তাই এ হাদীস হাসান পর্যায়ভুক্ত।



ইমাম ইবনে কুদামা (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, “মহানবী (ﷺ)-এর রওযা শরীফের যেয়ারত মোস্তাহাব (প্রশংসনীয়), যা হযরত ইবনে উমর (রা:)-এর সূত্রে আদ্ দারাকুতনী সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন এই মর্মে যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেন, ’যে ব্যক্তি হজ্জ্ব করে, তার উচিত আমার রওযা শরীফ য়েযারত করা; কারণ তা যেন আমার হায়াতে জিন্দেগীর সময়ে আমার-ই দর্শন লাভ হবে।’ তিনি আরেকটি হাদীসে এরশাদ ফরমান, ‘যে কেউ আমার রওযা যেয়ারত করলে তার জন্যে শাফায়াত (সুপারিশ) করা আমার প্রতি ওয়াজিব হয়’।” [ইমাম ইবনে কুদামা কৃত আল-মুগনী, ৫ম খণ্ড, ৩৮১ পৃষ্ঠা]



* ইমাম আল-বাহুতী আল-হাম্বলী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) নিজ আল-কাশাফ আল-ক্কান্না গ্রন্থের ২য় খণ্ডের ২৯০ পৃষ্ঠায় একই কথা বলেন।



ইমাম কাজী আয়ায (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) তাঁর সুপ্রসিদ্ধ ‘শেফা শরীফ’ পুস্তকের ‘মহানবী (ﷺ)-এর রওযা মোবারক যেয়ারতের নির্দেশ এবং কারো দ্বারা তা যেয়ারত ও সালাম (সম্ভাষণ) জানানোর ফযীলত’ শীর্ষক অধ্যায়ে বলেন, ”এটি জ্ঞাত হওয়া উচিত যে মহানবী (ﷺ)-এর মোবারক রওযা যেয়ারত করা সকল মুসলমানের জন্যে ‘মাসনূন’ (সর্বজনবিদিত রীতি); আর এ ব্যাপারে উলেমাবৃন্দের এজমা’ হয়েছে। এর এমন-ই ফযীলত যা হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه)-এর বর্ণিত হাদীস দ্বারা আমাদের জন্যে সাব্যস্ত হয়েছে (অর্থাৎ, ’কেউ আমার রওযা যেয়ারত করলে তার জন্যে আমার শাফায়াত ওয়াজিব হবে’)।”
 [ইমাম কাজী আয়ায কৃত ’শেফা শরীফ’, ২য় খণ্ড, ৫৩ পৃষ্ঠা]



জ্ঞাতব্য: চার মযহাবের সবগুলোতেই এটি অনুসরণীয়। অতএব, এই রওয়ায়াত দুর্বল মর্মে ওহাবীদের দাবির প্রতি কর্ণপাতের কোনো সুযোগ নেই। এটি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে আমাদের ওয়েবসাইটে।



দলিল নং - ১২ 



হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর হাদীস, যা’তে তিনি এরশাদ ফরমান: “আমার হায়াতে জিন্দেগী (প্রকাশ্য জীবন) তোমাদের জন্যে উপকারী, তোমরা তা বলবে এবং তোমাদেরকেও তা বলা হবে; আমার বেসালপ্রাপ্তিও তোমাদের জন্যে উপকারী, কেননা তোমাদের কর্মগুলো আমার কাছে পেশ করা হবে। নেক-কর্ম দেখলে আমি আল্লাহর প্রশংসা করি, আর বদ আমল দেখলে আমি তোমাদের হয়ে আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করি।”



রেফারেন্স  



* ইমাম হায়তামী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) নিজ ‘মজমুয়া’-উয-যাওয়াইদ’ (৯:২৪) পুস্তকে জানান যে হাদীসটি আল-বাযযার তাঁর ’মুসনাদ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন এবং এর সকল ’রাবী’ (বর্ণনাকারী) সহীহ (মানে হাদীসটি সহীহ)।



* এরাকী (সম্ভবতঃ যাইনউদ্দীন) এ হাদীসের বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করেছেন তাঁর-ই ‘তারহ-উত-তাতরিব ফী শারহ-ইত-তাক্করিব’ গ্রন্থে (৩:২৯৭)।



* ইবনে সা’আদ নিজস্ব ‘আত-তাবাক্কাত-উল-কুবরা’ পুস্তকে (২:১৯৪) এটি লিপিবদ্ধ করেন।



* ইমাম কাজী আয়ায (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) স্বরচিত ‘শেফা’ গ্রন্থে (১:১৯) এই হাদীসটি উদ্ধৃত করেন।



* ইমাম সৈয়ুতী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি), যিনি এটি নিজ ‘আল-খাসাইস আল-কুবরা’ (২:২৮১) ও ‘মানাহিল-উস- সেফা ফী তাখরিজ-এ-আহাদীস আশ-শেফা’ (পৃষ্ঠা ৩) পুস্তকগুলোতে লিপিবদ্ধ করেন, তিনি বিবৃত করেন যে আবূ উসামাহ নিজ ‘মুসনাদ’ পুস্তকে বকর বিন আব্দিল্লাহ মুযানী (رضي الله عنه)-এর সূত্রে এবং আল-বাযযার তাঁর ‘মুসনাদ’ বইয়ে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه)-এর সূত্রে সহীহ সনদে এই হাদীস লিপিবদ্ধ করেন। খাফাযী স্বরচিত ‘নাসিমুর রিয়াদ’ (১:১০২) ও মোল্লা আলী কারী তাঁর ‘শরহে শেফা’(১:৩৬) শিরোনামের ব্যাখ্যাগ্রন্থগুলোতে এটি সমর্থন করেন।



* মোহাদ্দীস ইবনুল জাওযী এটি বকর বিন আব্দিল্লাহ (رضي الله عنه) ও হযরত আনাস বিন মালেক (رضي الله عنه)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন তাঁর-ই প্রণীত ‘আল-ওয়াফা বি-আহওয়ালিল মোস্তফা’ পুস্তকে (২:৮০৯-১০)। ইমাম তাকিউদ্দীন সুবকী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) নিজ ‘শেফাউস্ সেকাম ফী যেয়ারাতে খায়রিল আনাম’ (৩৪ পৃষ্ঠা) বইয়ে বকর ইবনে আব্দিল্লাহ মুযানী(رضي الله عنه) হতে এ হাদীস নকল করেছেন এবং ইবনে আব্দিল হাদী তাঁর ‘আস্ সারিম-উল-মুনকি’ (২৬৬-৭ পৃষ্ঠায়) পুস্তকে এটির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।



* আল-বাযযারের বর্ণনাটি ইবনে কাসীরও তার ‘আল-বেদায়া ওয়ান-নেহায়া’ (৪:২৫৭) পুস্তকে লিপিবদ্ধ করে।



* ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) নিজ ‘আল-মাতালিব-উল-আলিয়্যাহ’ (৪:২২-৩ #৩৮৫৩) গ্রন্থে এই হাদীসটি বকর ইবনে আব্দিল্লাহ মুযানী (রা:)-এর সূত্রে লিপিবদ্ধ করেন।



* আলাউদ্দীন আলী নিজস্ব ‘কানযুল উম্মাল’ পুস্তকে (১১:৪০৭ #৩১৯০৩) ইবনে সাআদের বর্ণিত হাদীসটি উদ্ধৃত করেন এবং হারিস হতেও একটি রওয়ায়াত উদ্ধৃত করেন (# ৩১৯০৪)।



* ইমাম ইউসূফ নাবহানী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) স্বরচিত ‘হুজ্জাতুল্লাহ আলাল আ’লামীন ফী মো’জেযাত-এ-সাইয়্যেদিল মুরসালীন’ শীর্ষক পুস্তকে (৭১৩ পৃষ্ঠা) এই হাদীস বর্ণনা করেন।  



দলিল নং - ১৩ 



হযরত নাফে’ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, “আমি হযরত (আবদুল্লাহ) ইবনে উমর (رضي الله عنه)-কে দেখেছি এক’শ বার বা তারও বেশি সময় মহানবী (ﷺ)-এর পবিত্র রওযা শরীফ যেয়ারত করেছেন। তিনি সেখানে বলতেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক; আল্লাহতা’লা তাঁকে আশীর্বাদধন্য করুন এবং সুখ-শান্তি দিন। হযরত আবূ বকর (رضي الله عنه)-এর প্রতিও শান্তি বর্ষিত হোক।’ অতঃপর তিনি প্রস্থান করতেন। হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه)-কে রওযা মোবারক হাতে স্পর্শ করে ওই হাত মুখে (বরকত আদায় তথা আশীর্বাদ লাভের উদ্দেশ্যে) মুছতেও দেখা গিয়েছে।”
 [ইমাম কাজী আয়ায (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) কৃত ‘শেফা শরীফ’ গ্রন্থের ৯ম অনুচ্ছেদে বর্ণিত]



দলিল নং - ১৪ [হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযযালী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর ভাষ্য]



ইমাম গাযযালী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন এবং এটি কোনো হাদীস নয়: “কারো যখন কোনো অসুবিধা (তথা পেরেশানি) হয়, তখন তার উচিত মাযারস্থ আউলিয়াবৃন্দের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা; এঁরা হলেন সে সকল পুণ্যাত্মা যাঁরা দুনিয়া থেকে বেসাল হয়েছেন। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ-ই নেই, যে ব্যক্তি তাঁদের মাযার যেয়ারত করেন, তিনি তাঁদের কাছ থেকে রূহানী মদদ (আধ্যাত্মিক সাহায্য) লাভ করেন এবং বরকত তথা আশীর্বাদও প্রাপ্ত হন; আর বহুবার আল্লাহর দরবারে তাঁদের অসীলা পেশ হবার দরুন মসিবত বা অসুবিধা দূর হয়েছে।” [তাফসীরে রূহুল মা’আনী, ৩০তম খণ্ড, ২৪ পৃষ্ঠা]



জ্ঞাতব্য: ‘এসতেগাসাহ’ তথা আম্বিয়া (আ:) ও আউলিয়া (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর কাছে সাহায্য প্রার্থনার বিষয়টি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে আহলুস্ সুন্নাহ’র ওয়েবসাইটের ‘ফেকাহ’ বিভাগে ‘আম্বিয়া (আ:) ও আউলিয়া (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর রূহানী মদদ’ শীর্ষক লেখাটি দেখুন।



দলিল নং - ১৫ [ইমাম শাফেঈ (رضي الله عنه)]  



ইমাম আবূ হানিফা (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর মাযারে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনাকালে ইমাম শাফেঈ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, “আমি ইমাম আবু হানিফা (رضي الله عنه)  হতে বরকত আদায় করি এবং তাঁর মাযার শরীফ প্রতিদিন যেয়ারত করি। আমি যখন কোনো সমস্যার মুখোমুখি হই, তখন-ই দুই রাকআত নফল নামায পড়ে তাঁর মাযার শরীফ যেয়ারত করি; আর (দাঁড়িয়ে) সমাধানের জন্যে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করি। ওই স্থান ত্যাগ করার আগেই আমার সমস্যা সমাধান হয়ে যায়।”



রেফারেন্স 



* খতীব বাগদাদী সহীহ সনদে এই ঘটনা বর্ণনা করেন তাঁর কৃত ‘তারিখে বাগদাদ’ গ্রন্থে (১:১২৩)



ইবনে হাজর হায়তামী প্রণীত ‘আল-খায়রাত আল-হিসান ফী মানাক্কিবিল ইমাম আল-আ’যম আবূ হানিফা’ (৯৪ পৃষ্ঠা)

* মোহাম্মদ যাহেদ কাওসারী, ‘মাক্কালাত’ (৩৮১ পৃষ্ঠা)



* ইবনে আবেদীন শামী, ‘রাদ্দুল মোহতার আ’লা দুররিল মোখতার’ (১:৪১)



জ্ঞাতব্য: এটি সমর্থনকারী দালিলিক প্রমাণ হিসেবে পেশকৃত এবং এটি একটি ’হুজ্জাহ’, কেননা চার মযহাবের অনেক ফুকাহা একে দলিল হিসেবে গ্রহণ করেছেন।



দলিল নং - ১৬ [শায়খুল ইসলাম হাফেয ইমাম নববী (رضي الله عنه)]



ইমাম সাহেব নিজ ’কিতাবুল আযকার’ পুস্তকের ‘মহানবী (ﷺ)-এর মোবারক রওযা যেয়ারত ও সেখানে পালিত যিকর’ শীর্ষক অধ্যায়ে লেখেন: “এ কথা জ্ঞাত হওয়া উচিত, ’যে কেউ’ হজ্জ্ব পালন করলে তাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর রওযা মোবারক যেয়ারত করতে হবে, ’তা তার  গন্তব্য পথের ওপর হোক বা না-ই হোক’; কারণ যেয়ারতে রাসূল (ﷺ) হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবাদতগুলোর অন্যতম, সবচেয়ে পুরস্কৃত আমল, এবং সবচেয়ে ইপ্সিত লক্ষ্য। যেয়ারতের উদ্দেশ্যে কেউ বের হলে পথে বেশি বেশি সালাত ও সালাম পড়া উচিত। আর মদীনা মোনাওয়ারার গাছ, পবিত্র স্থান ও সীমানার চিহ্ন দৃশ্যমান হওয়ামাত্র-ই সালাত-সালাম আরও বেশি বেশি পড়তে হবে তার; অধিকন্তু এই ‘যেয়ারত’ দ্বারা যাতে নিজের উপকার হয়, সে জন্যে আল্লাহর দরবারে তার ফরিয়াদ করাও উচিত; আল্লাহ যেন তাকে এই যেয়ারতের মাধ্যমে ইহ-জাগতিক ও পারলৌকিক কল্যাণ দান করেন, এই কামনা তাকে করতে হবে। তার বলা উচিত, ‘এয়া আল্লাহ! আপনার করুণার দ্বার আমার জন্যে অবারিত করুন, এবং রওযায়ে আকদস যেয়ারতের মাধ্যমে সেই আশীর্বাদ আমায় মঞ্জুর করুন, যেটি আপনি মঞ্জুর করেছেন আপনার-ই বন্ধুদের প্রতি, যাঁরা আপনাকে মানেন। যাঁদের কাছে চাওয়া হয় তাঁদের মধ্যে ওহে সেরা সত্তা, আমায় ক্ষমা করুন এবং আমার প্রতি দয়া করুন।” [ইমাম নববী রচিত ‘কিতাবুল আযকার’, ১৭৮ পৃষ্ঠা] 



দলিল নং - ১৭ [ইবনে কাইয়্যেম আল-জাওযিয়্যা]



(ইবনে কাইয়্যেম ‘সালাফী’দের গুরু। সে তার শিক্ষক ইবনে তাইমিয়্যার ধ্যান-ধারণার গোঁড়া সমর্থক, যার দরুন সে তার ইমামের সেরা শিষ্য হিসেবে পরিচিতি লাভ করে)



ইবনে কাইয়্যেম লেখে:



“প্রথম অধ্যায় - ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ তাঁদের কবর যেয়ারতকারীদেরকে চিনতে পারেন কি-না এবং তাঁদের সালামের উত্তর দিতে পারেন কি-না?        



”হযরত ইবনু আবদিল বার (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) থেকে বর্ণিত: নবী করীম (ﷺ) এরশাদ ফরমান, কোনো মুসলমান যখন তাঁর কোনো পূর্ব-পরিচিত ভাইয়ের কবরের পাশে যান এবং তাঁকে সালাম জানান, তখন আল্লাহতা’লা ওই সালামের জবাব দেয়ার জন্যে মরহুমের রূহকে কবরে ফিরিয়ে দেন এবং তিনি সে সালামের জবাব দেন। এর দ্বারা বোঝা গেল যে ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তি যেয়ারতকারীকে চিনতে পারেন এবং তাঁর সালামের জবাবও দিয়ে থাকেন



”বোখারী ও মুসলিম শরীফের বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত আছে, মহানবী (ﷺ) বদর যুদ্ধে নিহত কাফেরদের লাশ একটি কূপে নিক্ষেপ করার আদেশ দেন। এরপর তিনি সেই কূপের কাছে গিয়ে দাঁড়ান এবং এক এক করে তাদের নাম ধরে সম্বোধন করে বলেন, ‘হে অমুকের পুত্র তমুক, হে অমুকের পুত্র তমুক, তোমরা কি তোমাদের রবের (প্রভুর) প্রতিশ্রুতি সঠিকভাবে পেয়েছো? আমি তো আমার রবের ওয়াদা ঠিকই পেয়েছি।’ তা শুনে হযরত উমর ফারূক (رضي الله عنه) বল্লেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ), আপনি কি এমন লোকদেরকে সম্বোধন করছেন যারা লাশে পরিণত হয়েছে?’ হুযূর পাক (ﷺ) বল্লেন, ‘যিনি আমাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন তাঁর শপথ, আমার কথাগুলো তারা তোমাদের চেয়েও অধিকতর স্পষ্টভাবে শুনতে পেয়েছে; কিন্তু তারা এর উত্তর দিতে অক্ষম।’ প্রিয়নবী (ﷺ) থেকে আরও বর্ণিত আছে, কোনো ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে দাফন করার পর লোকেরা যখন ফিরে আসতে থাকে, তখন সেই ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তি তাদের জুতোর শব্দ পর্যন্ত শুনতে পান।
 (আল-ফাতহুল কবীর, ১ম খণ্ড, ১৬৯ পৃষ্ঠা)



”এছাড়া রাসূলে মকবূল (ﷺ) তাঁর উম্মতদেরকে এ শিক্ষাও দিয়েছেন, যখন তাঁরা কবরবাসীকে সালাম দেবেন, তখন যেন সামনে উপস্থিত মানুষদেরকে যেভাবে সালাম দেন, ঠিক সেভাবে সালাম দেবেন। তাঁরা যেন বলেন, ‘আস্ সালামু আলাইকুম দারা কাওমিম্ মু’মিনীন।’ অর্থাৎ, ‘হে কবরবাসী মু’মিনবৃন্দ, আপনাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক।’ এ ধরনের সম্বোধন তাদেরকেই করা হয় যারা শুনতে পান এবং বুঝতেও পারেন। নতুবা কবরবাসীকে এভাবে সম্বোধন করা হবে জড় পদার্থকে সম্বোধন করার-ই শামিল। 
[ইবনে কাইয়্যেম কৃত ’কিতাবুর রূহ’ - রূহের রহস্য, ৭-৮ পৃষ্ঠা, বাংলা সংস্করণ ১৯৯৮ খৃষ্টাব্দ, অনুবাদক - মওলানা লোকমান আহমদ আমীমী]



ইবনে কাইয়্যেম আরও লেখে:



”হযরত ফযল (رضي الله عنه) ছিলেন হযরত ইবনে উবায়না(رضي الله عنه)-এর মামাতো ভাই। তিনি বর্ণনা করেন, যখন আমার পিতার ইন্তেকাল হলো, তখন আমি তাঁর সম্পর্কে খুবই ভীত-সন্ত্রস্ত ও চিন্তিত হয়ে পড়লাম। আমি প্রত্যহ তাঁর কবর যেয়ারত করতাম। ঘটনাক্রমে আমি কিছুদিন তাঁর কবর যেয়ারত করতে যেতে পারিনি। পরে একদিন আমি তাঁর কবরের কাছে এসে বসলাম এবং ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের মধ্যে আমি দেখলাম, আমার পিতার কবরটি যেন হঠাৎ ফেটে গেলো। তিনি কবরের মধ্যে কাফনে আবৃত অবস্থায় বসে আছেন। তাঁকে দেখতে মৃতদের মতোই মনে হচ্ছিলো। এ দৃশ্য দেখে আমি কাঁদতে লাগলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, প্রিয় বৎস, তুমি এতোদিন পরে এলে কেন? আমি বল্লাম, বাবা, আমার আসার খবর কি আপনি জানতে পারেন? তিনি বল্লেন, তুমি যখন-ই এখানে আসো, তোমার খবর আমি পেয়ে যাই। তোমার যেয়ারত ও দোয়ার বরকতে আমি শুধু উপকৃত হই না, আমার আশপাশে যাঁরা সমাহিত, তাঁরাও উল্লসিত, আনন্দিত এবং উপকৃত হন। এ স্বপ্ন দেখার পর আমি সব সময় আমার পিতার কবর যেয়ারত করতে থাকি।” [ প্রাগুক্ত, ৯-১০ পৃষ্ঠা]



জরুরি জ্ঞাতব্য: এখানে ইবনে কাইয়্যেম স্বয়ং একটি সন্দেহের অপনোদন করেছে এ মর্মে যে স্বপ্ন কীভাবে কোনো কিছুর প্রমাণ হতে পারে, যে প্রশ্নটি কারো ভাবনায় উদিত হওয়া সম্ভব। সে বলে, স্বপ্ন কোনো দালিলিক প্রমাণ না হলেও এর বিবরণ এতো অধিক পরিমাণে এসেছে, আর তাও আবার সত্যনিষ্ঠ ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিদের কাছ থেকে এগুলো বর্ণিত হওয়ায় এগুলোকে তাঁদের (জাগ্রত অবস্থায়) কথপোকথনের সমকক্ষ বিবেচনা করতে হবে। কেননা, তাঁদের দৃষ্টিতে যা মহান, তা আল্লাহর দৃষ্টিতেও উত্তম। এ ছাড়া সুস্পষ্ট প্রামাণ্য দলিল দ্বারাও এই বিষয়টি সপ্রমাণিত। [কিতাবুর রূহ]



ইবনে কাইয়্যেম আরও লেখে:



”অতীতকাল থেকে ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তিদেরকে কবরে তালকীন করার নিয়ম চলে আসছে। অর্থাৎ,কলেমা-এ-তাইয়্যেবাহ তাঁদেরকে পড়ে শোনানো হয়ে থাকে। ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ যে ইন্তেকালের পরে শুনতে পান, তালকীনের মাধ্যমেও তা প্রমাণিত হয়। এছাড়া তালকীনের দ্বারা ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ উপকৃত হন; তা না হলে তালকীন করার কোনো অর্থ-ই হয় না



”উক্ত (তালকীনের) বিষয়ে ইমাম আহমদ হাম্বল (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তিদেরকে তালকীন করা একটি নেক কাজ; মানুষের আ’মল থেকে তা প্রমাণিত হয়। তালকীন সম্পর্কে মু’জাম তাবরানী গ্রন্থের মধ্যে হযরত আবূ উমামা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত একটি দুর্বল হাদীসও রয়েছে। হাদীসটি হলো, নূরনবী (ﷺ) এরশাদ ফরমান: ‘কোনো ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে কবরে মাটি দেয়ার পর তোমাদের একজন তাঁর শিয়রের দিকে দাঁড়িয়ে তাঁর নাম ও তাঁর মায়ের নাম ধরে ডাক দেবে। কেননা, ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তি তা শুনতে পান, কিন্তু উত্তর দিতে পারেন না। দ্বিতীয়বার তাঁর নাম ধরে ডাক দিলে তিনি উঠে বসেন। আর তৃতীয়বার ডাক দিলে তিনি উত্তর দেন, কিন্তু তোমরা তা শুনতে পাও না। তোমরা তালকীনের মাধ্যমে বলবে, আল্লাহ পাক আপনার প্রতি রহম করুন, আমাদের তালকীনের দ্বারা আপনি উপকৃত হোন। তারপর বলবে, আপনি তাওহীদ ও রেসালাতের যে স্বীকৃতি দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন, তা স্মরণ করুন। অর্থাৎ, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ বাক্যটি পাঠ করুন ও তা স্মরণ রাখুন। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন, দ্বীনে ইসলাম, হযরত মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের নবুয়্যত এবং কুরআন মজীদ যে আমাদের পথপ্রদর্শনকারী, এ সব বিষয়ে যে আপনি রাজি ছিলেন, তাও স্মরণ করুন।’ এই তালকীন শুনে মুনকার-নকীর ফেরেশতা দু’জন সেখান থেকে সরে যান এবং বলেন, চলো, আমরা ফিরে যাই; এর কাছে থাকার আমাদের আর কোনো প্রয়োজন নেই। এ ব্যক্তিকে তাঁর ঈমান ও আকীদা-বিশ্বাস সম্পর্কে সব কিছুই স্মরণ কয়ে দেয়া হয়েছে। আর তাই তিনি তালকীনের মাধ্যমে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন।”
 [প্রাগুক্ত, ২০ পৃষ্ঠা, বাংলা সংস্করণ]



দলিল নং - ১৮ 



হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়াব (رضي الله عنه) বলেন, “মসজিদে নববী শরীফে যেদিন (অর্থাৎ, ’হাররা’র ঘটনার দিন; ৬১ হিজরীর ওই দিনে এয়াজীদী বাহিনী মদীনাবাসীর ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন চালিয়েছিল) আযান দেয়া যায়নি এবং নামায পড়া যায়নি, সেদিন ’আল-হুজরাত আন্ নববীয়্যা’ (রওযা শরীফ) হতে আযান ও একামত পাঠ করতে শোনা গিয়েছিল।”



রেফারেন্স 



ইবনে তাইমিয়া (মৃত্যু: ৭২৮ হিজরী/১৩২৮ খৃষ্টাব্দ)-ও নিজ ‘একতেদা’ আস্ সিরাতিল্ মুসতাকিম’ পুস্তকে এ ঘটনা বর্ণনা করেছে।





দলিল নং - ১৯


ইবনে কাইয়্যেম আল-জাওযিয়্যা নিজ ‘কিতাবুর রূহ’ পুস্তকে ইবনে আবিদ্ দুনইয়া (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর সূত্রে সাদাকাহ ইবনে সুলাইমান (رضي الله عنه)-এর কথা উদ্ধৃত করেন, যিনি বর্ণনা করেন: একবার তিনি (সাদাকাহ) একটি কুৎসিত চারিত্রিক দোষে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ইতোমধ্যে তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন। পিতার ইন্তেকালের পরে তিনি তাঁর কৃতকর্মের জন্যে লজ্জিত হন। অতঃপর তিনি তাঁর পিতাকে স্বপ্নে দেখেন। তাঁর পিতা বলেন, প্রিয় পুত্র, আমি তোমার নেক আমলের কারণে কবরে শান্তিতে ছিলাম। তোমার নেক আমল আমাদেরকে দেখানো হয়। কিন্তু সম্প্রতি তুমি যা করেছ, তা আমাকে আমার ইন্তেকালপ্রাপ্ত সঙ্গিদের কাছে অত্যন্ত শরমিন্দা (লজ্জিত) করেছে। আমাকে আর তুমি আমার ইন্তেকালপ্রাপ্ত সঙ্গিদের সামনে লজ্জিত করো না
 [কিতাবুর রূহ, বাংলা সংস্করণ, ১১ পৃষ্ঠা, ১৯৯৮]



দলিল নং - ২০ 



ইবরাহিম ইবনে শায়বান বলেন: আমি কোনো এক বছর হজ্জ্বে গেলে মদীনা মোনাওয়ারায় মহানবী (ﷺ)-এর রওযা শরীফেও যেয়ারত উদ্দেশ্যে যাই। তাঁকে সালাম জানানোর পরে ’হুজরাহ আস্ সাআদা’র ভেতর থেকে জবাব শুনতে পাই: ‘ওয়া আলাইকুম আস্ সালাম’


এই বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন মোহাম্মদ ইবনে হিব্বান (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর সূত্রে আবূ নু’য়াইম তাঁর কৃত ‘আত্ তারগিব’ (# ১০২) পুস্তকে; ইবনে আন্ নাজ্জার নিজ ‘আখবার আল-মদীনা’ গ্রন্থে (১৪৬ পৃষ্ঠা)। ইবনে জাওযী স্বরচিত ‘মুতির আল-গারাম’ বইয়ে (৪৮৬-৪৯৮ পৃষ্ঠা) এটি উদ্ধৃত করেন; আল-ফায়রোযাবাদী এ রওয়ায়াত তার ‘আল-সিলাত ওয়াল্ বুশর’ পুস্তকে (৫৪ পৃষ্ঠা) এবং ইবনে তাইমিয়া নিজ ‘এয়াতেদা’ আল-সীরাত আল-মুস্তাকীম’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ৩৭৩-৩৭৪) এই বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে।



দলিল নং - ২১ 



ইবনে তাইমিয়াকে জিজ্ঞেস করা হয় ইন্তেকালপ্রাপ্ত মুসলমানবৃন্দ তাঁদের যেয়ারতকারীদেরকে চিনতে পারেন কি-না। সে জবাবে বলে: “যেয়ারতকারীদেরকে যে ইন্তেকালপ্রাপ্ত মুসলমানবৃন্দ চিনতে পারেন, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ-ই নেই।” তার কথার সমর্থনে সে নিম্নের হাদীসটি পেশ করে, “ইন্তেকালপ্রাপ্তদের সচেতনতার পক্ষে প্রামাণিক দলিল হচ্ছে বোখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত একখানা হাদীস, যা’তে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেন যে কোনো ইন্তেকালপ্রাপ্ত মুসলমানকে দাফনের পরে ঘরে প্রত্যাবর্তনকারী মানুষের পায়ের জুতোর শব্দ ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তি শুনতে পান।”
 [ইবনে তাইমিয়ার ‘মজমুয়া’ আল-ফাতাওয়া’, ২৪তম খণ্ড, ৩৬২ পৃষ্ঠা]



দলিল নং - ২২ [ইবনুল জাওযী]



ইবনুল জাওযী এ বিষয়ে একখানা বই লেখেন, যেখানে তিনি আউলিয়া কেরাম (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর জীবনীর বিস্তারিত বিবরণ দেন। তিনি লেখেন:



হযরত মা’রূফ কারখী (বেসাল: ২০০ হিজরী): ”তাঁর মাযার শরীফ বাগদাদে অবস্থিত; আর তা থেকে মানুষেরা বরকত আদায় করেন। ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর সাথী হাফেয ইবরাহীম আল-হারবী (বেসাল: ২৮৫ হিজরী) বলতেন, হযরত মা’রূফ কারখী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর মাযার শরীফ হচ্ছে পরীক্ষিত আরোগ্যস্থল” (২:২১৪)। ইবনে জাওযী আরও বলেন, “আমরা নিজেরাই ইবরাহীম আল-হারবী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর মাযার যেয়ারত করে তা থেকে বরকত আদায় করে থাকি।” [২:৪১০]



হাফেয যাহাবীও হযরত ইবরাহীম আল-হারবী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর উপরোক্ত কথা (হযরত মা’রূফ কারখী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর মাযার শরীফ হচ্ছে পরীক্ষিত আরোগ্যস্থল) বর্ণনা করেন। 
 [‘সিয়্যার আ’লম আল-নুবালা’, ৯:৩৪৩]



ইবনে আল-জাওযী নিজ ‘মুতির আল-গারাম আস্ সাকিন ইলা আশরাফ আল-আমাকিন’ গ্রন্থে লেখেন:



মহানবী (ﷺ)-এর রওযা মোবারক যেয়ারত অধ্যায় 



রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর রওযা মোবারক যেয়ারতকারীর উচিত যথাসাধ্য শ্রদ্ধাসহ সেখানে দাঁড়ানো, এমনভাবে যেন তিনি হুযূর পাক (ﷺ)-এর হায়াতে তাইয়েবার সময়েই তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করছেন। হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন মহানবী (ﷺ)-এর বাণী, যিনি এরশাদ ফরমান: “যে ব্যক্তি হজ্জ্ব সম্পন্ন করে আমার বেসালের পরে আমার-ই রওযা মোবারক যেয়ারত করলো, সে যেন আমার যাহেরী জিন্দেগীর সময়েই আমার সাক্ষাৎ পেলো।” হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه) আরও বর্ণনা করেন নবী করীম (ﷺ)-এর হাদীস, যিনি এরশাদ ফরমান: “যে ব্যক্তি আমার রওযা পাক যেয়ারত করে, সে আমার শাফায়াত পাওয়ার যোগ্য হয়।” হযরত আনাস (رضي الله عنه) মহানবী (ﷺ)-এর হাদীস বর্ণনা করেন, যিনি এরশাদ ফরমান: “যে ব্যক্তি একমাত্র আমার যেয়ারতের উদ্দেশ্যেই (’মোহতাসিবান’) মদীনায় আমার (রওযা) যেয়ারত করতে আসে, শেষ বিচার দিবসে আমি-ই তার পক্ষে সাক্ষী ও সুপারিশকারী হবো।”



হাফেয ইবনে জাওযী কৃত ‘কিতাব আল-ওয়াফা’ 



আবূ বকর মিনকারী বলেন: আমি কিছুটুকু পেরেশানি অবস্থায় হাফেয আত্ তাবারানী ও আবূল শায়খের সাথে মসজিদে নববীর ভেতরে অবস্থান করছিলাম। ওই সময় আমরা ভীষণ অভুক্ত ছিলাম। ওই দিন এবং ওর আগের দিন কিছুই আমরা খাইনি। এশা’র নামাযের সময় হলে আমি রাসূলে খোদা (ﷺ)-এর রওযা পাকের সামনে অগ্রসর হই এবং আরয করি, ‘এয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! আমরা ক্ষুধার্ত, আমরা ক্ষুধার্ত (এয়া রাসূলাল্লাহ আল-জু’ আল-জু’)!’ অতঃপর আমি সরে আসি। আবূ শায়খ আমাকে বলেন, ’বসুন। হয় আমাদের জন্যে খাবারের ব্যবস্থা হবে, নয়তো এখানেই মারা যাবো।’ এমতাবস্থায় আমি ঘুমিয়ে পড়ি এবং আবূ আল-শায়খও ঘুমিয়ে পড়েন। আত্ তাবারানী জেগে থেকে কিছু একটি নিয়ে অধ্যয়ন করছিলেন। ওই সময় এক আলাউইয়ী (হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র বংশধর) দরজায় এসে উপস্থিত; তাঁর সাথে ছিল দুইজন বালক, যাদের প্রত্যেকের হাতে ছিল খাবারভর্তি একখানা তাল-পাতার ঝুড়ি। আমরা উঠে বসে খাবার গ্রহণ আরম্ভ করলাম। আমরা মনে করেছিলাম, বাচ্চা দু’জন অবশিষ্ট খাবার ফেরত নিয়ে যাবে। কিন্তু তারা সবই রেখে যায়। আমাদের খাওয়া শেষ হলে ওই আলাউইয়ী বলেন, ‘ওহে মানব সকল, আপনারা কি রাসূলুল্রাহ (ﷺ)-এর কাছে আরয করেছিলেন? আমি তাঁকে স্বপ্নে দেখি, আর তিনি আমাকে আপনাদের জন্যে খাবার নিয়ে আসতে বলেন
 [হাফেয ইবনে জাওযী, ‘কিতাব আল-ওয়াফা, ৮১৮ পৃষ্ঠা; # ১৫৩৬]



জ্ঞাতব্য: ইবনে জাওযী ছিলেন ’আল-জারহ ওয়াত্ তাদীল’-এর কঠোরপন্থী আলেমদের অন্যতম; আর তিনি এই বইয়ের প্রারম্ভেই উল্লেখ করেন যে তিনি বিশুদ্ধ রওয়ায়াতের সাথে মিথ্যে বিবরণগুলোর সংমিশ্রণ করেননি। (মানে তিনি শুধু বিশুদ্ধ বর্ণনাসম্বলিত ’সীরাহ’-বিষয়ক এ বইটি লিখেছেন; এতে সন্নিবেশিত হাদীসগুলো সহীহ বা হাসান পর্যায়ভুক্ত, যা সনদ কিংবা শওয়াহিদ (সাক্ষ্য)-সূত্রে ওই পর্যায়ে পৌঁছেছে)



দলিল নং - ২৩ [ইমাম জালালউদ্দীন সৈয়ুতী(رضي الله عنه)



ইমাম ইবনে আল-মোবারক নিজ ‘আয্ যুহদ’ পুস্তকে, হাকীম তিরমিযী তাঁর ‘নওয়াদিরুল উসূল’ গ্রন্থে, ইবনে আবিদ্ দুনইয়া ও ইবনে মুনদাহ বর্ণনা করেন সাঈদ ইবনে মুসাইয়াব (رضي الله عنه) থেকে; তিনি হযরত সালমান ফারিসী (رضي الله عنه) হতে, যিনি বলেন: ”মো’মেনীনবৃন্দের রূহ (আত্মা)-সমূহ এ পৃথিবীর ’বরযখে’ অবস্থান করেন এবং তাঁরা যেখানে ইচ্ছে যেতে পারেন; পক্ষান্তরে ’কুফফার’দের আত্মাগুলো ’সিজ্জিনে’ অবস্থিত....।” 



হাকীম তিরমিযী আরও অনুরূপ রওয়ায়াতসমূহ হযরত সালমান ফারিসী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন।



ইবনে আবিদ্ দুনইয়া হযরত মালেক ইবনে আনাস (ইমাম মালেক) থেকে বর্ণনা করেন; তিনি বলেন: “এই রওয়ায়াত আমার কাছে এসেছে এভাবে যে মো’মেনীনবৃন্দের আত্মাসমূহ মুক্ত এবং তাঁরা যেখানে চান যেতে পারেন।” [ইমাম সৈয়ুতী রচিত ‘শরহে সুদূর’, ১৬৭ পৃষ্ঠা]



অধিকন্তু, ইবনে কাইয়্যেম জাওযিয়্যা-ও নিজ ‘কিতাবুর রূহ’ বইয়ে এ বিষয়টি সপ্রমাণ করেছে [২৪৪ পৃষ্ঠা, দার-এ-ইবনে-কাসীর, দামেশ্ক, সিরিয়া হতে প্রকাশিত]



দলিল নং - ২৪ [হযরত আবূ আউয়ুব আনসারী (رضي الله عنه)-এর মাযার শরীফ]



হযরত আবূ আইয়ুব আনসারী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) মহান সাহাবীদের একজন। তিনি কনস্টিনটিনোপোল-এর যুদ্ধে অংশ নেন। শত্রু সীমানায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই অসুখ বেড়ে গেলে তিনি অসিয়ত (উইল) করেন, “আমার বেসালের পরে তোমরা আমার মরদেহ সাথে নিয়ে যাবে, আর শত্রুর মোকাবেলা করতে যখন তোমরা সারিবদ্ধ হবে, তখন তোমাদের কদমের কাছে আমাকে দাফন করবে।”



* ইবনে আব্দিল বারর, ‘আল-এসতেয়াব ফী মা’রিফাত-ইল-আসহাব’ (১:৪০৪-৫)



অতঃপর ইসলামের সৈনিকবৃন্দ তাঁর অসিয়ত অনুসারে তাঁকে দুর্গের দ্বারপ্রান্তে দাফন করেন এবং শত্রুদের সতর্ক করেন যেন তারা তাঁর মাযারের প্রতি অসম্মান না করে; তা করলে ইসলামী রাজ্যের কোথাও তাদের উপাসনালয়গওলো নিরাপদ থাকবে না। ফলে এমন কি শত্রুরাও তাঁর মাযারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে বাধ্য হয়েছিল। আর মানুষেরাও সত্বর তাঁর মাযার থেকে প্রবাহিত খোদায়ী করুণাধারা সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন। তাঁরা মাযারে এসে যা-ই প্রার্থনা করতেন, তা-ই তৎক্ষণাৎ মঞ্জুর হয়ে যেতো।



”আর হযরত আবূ আইয়ুব(رضي الله عنه)-এর মাযার কেল্লার কাছে অবস্থিত এবং তা সবাই জানেন....যখন মানুষেরা বৃষ্টির জন্যে প্রার্থনা জানায়, বৃষ্টিপাত আরম্ভ হয়।” 



* ইবনে আব্দিল বারর, প্রাগুক্ত ‘আল-এস্তেয়াব ফী মা’রিফাত-ইল-আসহাব’ (১:৪০৫)



মুজাহিদ বলেন, “দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে মানুষেরা মাযারের ছাদ খুলে দেন, আর বৃষ্টি নামে।”



দলিল নং - ২৫ [ইমাম বায়হাকী] 



[হাদীস নং ৩৮৭৯] আবূ এসহাক আল-কারশী (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, মদীনা মোনাওয়ারায় আমাদের সাথে এক ব্যক্তি ছিলেন, যিনি যখন-ই এমন কোনো খারাপ কাজ সংঘটিত হতে দেখতেন যাকে তিনি বাধা দিতে অক্ষম, তৎক্ষণাৎ তিনি মহানবী (ﷺ)-এর মোবারক রওযায় যেতেন এবং আরয করতেন, ‘হে মাযারের অধিবাসীবৃন্দ (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এবং শায়খাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) এবং আমাদের সাহায্যকারীমণ্ডলী! আমাদের অবস্থার দিকে কৃপাদৃষ্টি করুন।’ .... [হাদীস নং ৩৮৮০] আবূ হারব হেলালী (رضي الله عنه)) বর্ণনা করেন যে এক আরবী ব্যক্তি হজ্জ্ব সম্পন্ন করে মসজিদে নববীর দরজায় আসেন। তিনি সেখানে তাঁর উট বেঁধে মসজিদে প্রবেশ করেন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পবিত্র রওযার সামনে চলে আসেন। তিনি হুযূর পূর নূর (ﷺ)-এর কদম মোবারকের কাছে দাঁড়িয়ে আরয করেন: ‘এয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ), আপনার প্রতি সালাম।’ অতঃপর তিনি হযরত আবূ বকর (রা:) ও হযরত উমর (رضي الله عنه)-এর প্রতিও সালাম-সম্ভাষণ জানান। এরপর তিনি আবার বিশ্বনবী (ﷺ)-এর দিকে ফিরে আরয করেন: ”এয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! আপনার জন্যে আমার পিতা ও মাতা কোরবান হোন। আমি আপনার দরবারে এসেছি, কারণ আমি পাপকর্ম ও ভুলত্রুটিতে নিমজ্জিত, আর এমতাবস্থায় আপনাকে আল্লাহর কাছে যেন অসীলা করতে পারি এবং আপনিও আমার পক্ষে শাফায়াত করতে পারেন। কেননা, আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: ’এবং আমি কোনো রাসূল প্রেরণ করিনি কিন্তু এ জন্যে যে আল্লাহর নির্দেশে তাঁর আনুগত্য করা হবে; আর যদি কখনো তারা (মো’মেনীন) নিজেদের আত্মার প্রতি যুলুম করে, তখন হে মাহবুব, আপনার দরবারে হাজির হয়, অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, আর রাসূল (ﷺ)-ও তাদের পক্ষে সুপারিশ করেন, তবে অবশ্যই তারা আল্লাহকে অত্যন্ত তওবা কবুলকারী, দয়ালু পাবে’ [আল-কুরআন, ৪:৬৪; মুফতী আহমদ এয়ার খান কৃত ‘নূরুল এরফান’ বাংলা সংস্করণ]।” অতঃপর ওই ব্যক্তি সাহাবী (رضي الله عنه)-দের এক বড় দলের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলতে থাকেন, ’ওহে সেরা ব্যক্তিবৃন্দ যাঁরা (মাটির) গভীরে শায়িত’; ‘যাঁদের সুগন্ধিতে মাটির অভ্যন্তরভাগ ও বহির্ভাগ মিষ্ট স্বাদ পরিগ্রহ করেছে’; ’আপনি যে মাযারে শায়িত তার জন্যে আমার জান কোরবান’; ‘আর যে মাযার-রওযায় পবিত্রতা, রহমত-বরকত ও অপরিমিত দানশীলতা পাওয়া যায়।’

 [‘শুয়াবুল ঈমান, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ৬০ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ৩৮৭৯-৮০; আরবী উদ্ধৃতি পিডিএফ আকারে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে ইনশা’আল্লাহ]



দলিল নং - ২৬ [হাফেয ইবনে হিব্বান (رضي الله عنه)



ইমাম ইবনে হিব্বান (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনাকালে আল-রেযা (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর মাযারে তাঁর তাওয়াসসুলের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন এবং বলেন, “তুস্ নগরীতে অবস্থান করার সময় যখনই আমি কোনো সমস্যা দ্বারা পেরেশানগ্রস্ত হয়েছি, তৎক্ষণাৎ আমি হযরত আলী ইবনে মূসা রেযা (তাঁর নানা তথা হুযূর পাক ও তাঁর প্রতি আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক)-এর মাযার শরীফ যেয়ারত করতাম এবং আল্লাহর কাছে সমাধান চাইতাম। এতে আমার দোয়া কবুল হতো এবং পেরেশানিও দূর হতো। আমি এটি-ই করতাম এবং বহুবার এর সুফল পেয়েছি।” 
[ইবনে হিব্বান প্রণীত ‘কিতাবুস্ সিকাত’, ৮ম খণ্ড, ৪৫৬-৭ পৃষ্ঠা, # ১৪৪১১]



দলিল নং - ২৭   



ইমাম আবূ হানিফা (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বর্ণনা করেন ইমাম নাফে’ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) হতে, তিনি হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه) হতে; তিনি বলেন: “কেবলার দিক থেকে আসার সময় মহানবী (ﷺ)-এর রওযা-এ-আকদস যেয়ারতের সঠিক পন্থা হলো রওযার দিকে মুখ করে এবং কেবলার দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়াতে হবে; অতঃপর সালাম-সম্ভাষণ জানাতে হবে এই বলে - ‘হে আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর-ই রহমত ও বরকত (ﷺ), আপনার প্রতি সালাম’।” 
[মুসনাদে ইমামে আবি হানিফাহ, বাবে যেয়ারাতে কবর আন্ নবী (ﷺ)]



কুরআন তেলাওয়াত [কবরের পাশে]  



”এবং ওই সব লোক যারা তাদের পরে এসেছে, তারা আরয করে, ‘হে আমাদের রব্ব! আমাদের ক্ষমা করুন এবং আমাদের ভাইদেরও, যারা আমাদের আগে ঈমান এনেছেন; আর আমাদের অন্তরে ঈমানদারদের দিক থেকে হিংসা-বিদ্বেষ রাখবেন না! হে আমাদের রব্ব, নিশ্চয় আপনি অতি দয়ার্দ্র, দয়াময়।”
 [আল-কুরআন, ৫৯:১০]



তাফসীরে ইবনে কাসীরে এই আয়াতের ব্যাখ্যায় লেখা হয়:



”(এবং ওই সব লোক যারা তাদের পরে এসেছে, তারা আরয করে) এই আয়াতের মানে তারা যে বক্তব্য দেয়; (হে আমাদের রব্ব! আমাদের ক্ষমা করুন এবং আমাদের ভাইদেরও, যারা আমাদের আগে ঈমান এনেছেন; আর আমাদের অন্তরে ঈমানদারদের দিক থেকে হিংসা-বিদ্বেষ রাখবেন না) অর্থাৎ, কোনো রাগ বা ঈর্ষা; (আমাদের অন্তরে ঈমানদারদের দিক থেকে হিংসা-বিদ্বেষ রাখবেন না) সত্যি, এটি একটি উত্তম পন্থা যে ইমাম মালেক (رضي الله عنه) এই সম্মানিত আয়াতটি দেখিয়েই ঘোষণা করেছেন যে সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-এর প্রতি অভিসম্পাত দানকারী রাফেযী (শিয়া)-রা এই রহমত-বরকতের শরীকদার হওয়া থেকে বঞ্চিত। কারণ আল্লাহ এখানে যে সৎগুণের কথা উল্লেখ করেছেন তা তাদের নেই, যেমনটি এরশাদ হয়েছে (হে আমাদের রব্ব! আমাদের ক্ষমা করুন এবং আমাদের ভাইদেরও, যারা আমাদের আগে ঈমান এনেছেন; আর আমাদের অন্তরে ঈমানদারদের দিক থেকে হিংসা-বিদ্বেষ রাখবেন না! হে আমাদের রব্ব, নিশ্চয় আপনি অতি দয়ার্দ্র, দয়াময়)। ইবনে হাতিম লিপিবদ্ধ করেন যে হযরত মা আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, ’তাদেরকে যখন আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে বলা হলো, তখন তারা উল্টো তাঁদেরকে অভিসম্পাত দিলো।’ অতঃপর মা আয়েশা (رضي الله عنه) এই আয়াতটি তেলাওয়াত করেন - (এবং ওই সব লোক যারা তাদের পরে এসেছে, তারা আরয করে, ‘হে আমাদের রব্ব! আমাদের ক্ষমা করুন এবং আমাদের ভাইদেরও, যারা আমাদের আগে ঈমান এনেছেন; আর আমাদের অন্তরে ঈমানদারদের দিক থেকে হিংসা-বিদ্বেষ রাখবেন না)। 
[তাফসীরে ইবনে কাসীর]



ওপরে উল্লেখিত আয়াতটি পরিস্ফুট করে যে কেউ অপর কারো জন্যে দোয়া করলে আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি এর আধ্যাত্মিক সুবিধাগুলো পাবেন। এটি আরও প্রতিভাত করে যে এই কাজটি ভুল (বা গোমরাহী)  হলে আল্লাহ এভাবে অন্যদের জন্যে আমাদেরকে দোয়া করতে নির্দেশ দিতেন না। আর এ কথাও তিনি তাঁর কালামে পাকে বলতেন না যে বেসালপ্রাপ্তদের জন্যে ক্ষমাপ্রার্থনাকারীরা আল্লাহর প্রশংসা (তথা আশীর্বাদ) অর্জন করেন।



হাদীস শরীফ থেকে প্রমাণ 



দলিল নং - ১



ইমাম বোখারী(রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) ও ইমাম মুসলিম(রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) লেখেন:



”এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দরবারে এসে আরয করেন, ‘(হে আল্লাহর রাসূল - (ﷺ) আমার মা অকস্মাৎ ইন্তেকাল করেছেন এবং তিনি কোনো অসিয়ত (উইল) করে যাননি। তবে আমার মনে উদয় হয়েছে, তিনি তা চাইলে হয়তো কোনো দান-সদকা করার কথা আমাকে বলতেন। এক্ষণে আমি তাঁর পক্ষ থেকে কোনো দান-সদকাহ করলে তিনি কি এর সওয়াব পাবেন?’ মহানবী (ﷺ) জবাবে বলেন, ‘হ্যাঁ।’ এমতাবস্থায় ওই ব্যক্তি বলেন, ‘হে রাসূল (ﷺ), আমি আপনাকে আমার (খেজুর) ফলে পরিপূর্ণ বাগানটি সদকাহ হিসেবে দানের ব্যাপারে সাক্ষী করলাম’।”



* আল-বোখারী, ‘অসিয়ত’ অধ্যায়, ৪র্থ খণ্ড, বই নং ৫১, হাদীস নং ১৯

* মুসলিম শরীফ, ‘অসিয়ত‘ অধ্যায়, বই নং ১৩, হাদীস নং ৪০০৩



এই হাদীস থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, ইন্তেকালপ্রাপ্তদের পক্ষে কোনো দান-সদকাহ করা হলে তা ইন্তেকালপ্রাপ্তদের জন্যে সুফল বয়ে আনে।



দলিল নং - ২  



ইমাম বোখারী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) লেখেন: “মহানবী (ﷺ) এরশাদ ফরমান, ‘(কবর জীবনে) ইন্তেকালপ্রাপ্তের মর্যাদা উন্নীত করা হলে তিনি আল্লাহর কাছে এর কারণ জিজ্ঞেস করেন। আল্লাহতা’লা জবাবে বলেন, তোমার পুত্র তোমার জন্যে ক্ষমা চেয়ে দোয়া করেছে’।”



* আল-বোখারী, আল-আদাব আল-মোফিদ, ‘পিতা-মাতার শ্রেষ্ঠত্ব/মাহাত্ম্য’ অধ্যায়



এই বিশেষ হাদীস থেকে উপলব্ধি করা যায় যে কেবল দান-সদকাহ-ই নয়, বরং দোয়া ও আর্থিক সাহায্য করাও

ইন্তেকালপ্রাপ্তদের জন্যে খোদায়ী আশীর্বাদ বয়ে আনে।



দলিল নং - ৩



নবী পাক (ﷺ) এরশাদ করেন, “এটি (সূরা এয়াসিন) ইন্তেকালপ্রাপ্ত বা ইন্তেকাল হতে যাচ্ছে এমন ব্যক্তির কাছে (’ইনদা) পাঠ করো।”
 [সুনানে ইবনে মাজাহ, কিতাবুল জানায়েয # ১৪৩৮]



’সুনানে ইবনে মাজাহ’ গ্রন্থের ব্যাখ্যাকারী আরও বলেন, “হুযূর পাক (ﷺ)-এর ‘ইন্তেকালপ্রাপ্ত বা ইন্তেকাল হতে যাচ্ছে এমন ব্যক্তি’ এই বাণীর উদ্দেশ্য ইন্তেকাল হতে যাচ্ছে এমন ব্যক্তি অথবা (’আও’) ইন্তেকালপ্রাপ্ত (বা’দ) ব্যক্তিও।” 
[শরহে সুনানে ইবনে মাজাহ আল-সনদি, প্রাগুক্ত]



‘সুনানে আবি দাউদ’ পুস্তকের ’আওন আল-মা’বুদ শরহে সুনানে আবি দাউদ’ শীর্ষক ব্যাখ্যাগ্রন্থে বিবৃত হয়: “এবং নাসাঈ (শরীফে) হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিত হাদীসটি (যা’তে এরশাদ হয়েছে), মহানবী (ﷺ) জানাযার নামায পড়েন এবং সূরা ফাতেহা পাঠ করেন।”



দলিল নং - ৪ 



হুযূর পূর নূর (ﷺ) এরশাদ ফরমান, “একরা’ও ‘আলা মওতাকুম এয়াসীন”, মানে ‘তোমাদের মধ্যে ইন্তেকালপ্রাপ্ত বা ইন্তেকাল হতে যাচ্ছে এমন ব্যক্তিদের কাছে সূরা এয়াসীন পাঠ করো।’





রেফারেন্স


আবূ দাউদ কৃত ‘সুনান’ (জানায়েয)
নাসাঈ প্রণীত ‘সুনান’ (’আমল আল-এয়াওম ওয়াল-লায়লাহ)
* ইবনে মাজাহ রচিত ‘সুনান’ (জানায়েয)
* ইবনে হিব্বান লিখিত ‘সহীহ’ (এহসান); তিনি এটিকে সহীহ বলেছেন।



দলিল নং - ৫



হযরত মা’কিল ইবনে এয়াসার আল-মুযানি বর্ণনা করেন; মহানবী (ﷺ) এরশাদ ফরমান: “কেউ যদি সূরা এয়াসীন আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের উদ্দেশ্যে তেলাওয়াত করে, তবে তার পূর্ববর্তী গুনাহ মাফ হবে; অতএব, তোমাদের মধ্যে ইন্তেকাল হতে যাচ্ছে এমন ব্যক্তিদের কাছে তা পাঠ করো।”



ইমাম বায়হাকী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) এটি নিজস্ব ‘শুয়াবুল ঈমান’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।

আত্ তিরমিযী, হাদীস নং ২১৭৮



দলিল নং - ৬ [ইমাম নববী (রহ:)] 



সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত আমর ইবনুল আস্ (رضي الله عنه)-এর কথা বর্ণিত হয়েছে; তিনি বলেন: ’তোমরা যখন আমাকে দাফন করবে, তখন আমার কবরের পাশে ততোক্ষণ দাঁড়াবে যতোক্ষণ একটি উট যবেহ করে তার গোস্ত বিতরণ করতে সময় প্রয়োজন হয়; এতে আমি তোমাদের সঙ্গ লাভের সন্তুষ্টি পাবো এবং আল্লাহর ফেরেশতাদের কী জবাব দেবো তা মনঃস্থির করতে পারবো।’



ইমাম আবূ দাউদ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) ও ইমাম বায়হাকী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) ‘হাসান’ এসনাদে হযরত উসমান (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেন; তিনি বলেন: মহানবী (ﷺ) ইন্তেকালপ্রাপ্ত কারো দাফনের পরে তার (কবরের) পাশে দাঁড়াতেন এবং বলতেন, ‘এই ইন্তেকালপ্রাপ্তের গুনাহ মাফের জন্যে দোয়া করো, যাতে সে দৃঢ় থাকে; কেননা তাকে (কবরে) প্রশ্ন করা হচ্ছে।’



ইমাম শাফেঈ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) ও তাঁর শিষ্যবৃন্দ বলেন, ‘(কবরে) কুরআনের অংশবিশেষ তেলাওয়াত করা ভাল; কুরআন খতম করতে পারলে আরও উত্তম।’



’হাসান’ সনদে ‘সুনানে বায়হাকী’ গ্রন্থে বর্ণনা করা হয়েছে যে হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه) ইন্তেকালপ্রাপ্তদের দাফনের পরে কবরের পাশে সূরা বাকারাহ’র প্রারম্ভিক ও শেষ আয়াতগুলো তেলাওয়াত করাকে মোস্তাহাব বিবেচনা করতেন। [’কিতাবুল আযকার, ২৭৮ পৃষ্ঠা]



ইমাম নববী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন: “যে ব্যক্তি কবর যেয়ারত করেন, তিনি সেটির অধিবাসীকে সালাম-সম্ভাষণ জানাবেন, আল-কুরআনের অংশবিশেষ তেলাওয়াত করবেন এবং ইন্তেকালপ্রাপ্তের জন্যে দোয়া করবেন।”  



* ইমাম নববী রচিত ‘মিনহাজ আত্ তালেবীন’, কিতাবুল জানায়েয অধ্যায়ের শেষে।



’আল-মজমু’ শারহ আল-মুহাযযাব’ শীর্ষক গ্রন্থে ইমাম নববী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) আরও লেখেন: “এটি কাঙ্ক্ষিত (ইউস্তাহাব্ব) যে কবর যেয়ারতকারী তাঁর জন্যে সহজে পাঠযোগ্য কুরআনের কোনো অংশ তেলাওয়াত করবেন, যার পরে তিনি কবরস্থদের জন্যে আল্লাহর দরবারে দোয়া করবেন। ইমাম শাফেঈ (رضي الله عنه) এই শর্তারোপ করেন এবং তাঁর শিষ্যবৃন্দ তাঁর সাথে ঐকমত্য পোষণ করেন।” বইয়ের আরেক স্থানে তিনি বলেন: “যদি কুরআন খতম করা সম্ভব হয়, তবে তা আরও উত্তম।”



* ইমাম সৈয়ুতী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) ওপরের দু’টি উদ্ধৃতি-ই তাঁর প্রণীত ‘শরহে সুদুর’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন (৩১১ পৃষ্ঠা)।



উলেমাবৃন্দ কবরের পাশে কুরআন তেলাওয়াতকে মোস্তাহাব (কাম্য) বলে ঘোষণা করেছেন।”


* ইমাম নববী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) কৃত ‘শরহে সহীহ আল-মুসলিম’ (আল-মায়স্ সংস্করণ, ৩/৪: ২০৬)



দলিল নং - ৭



বর্ণিত আছে যে আল-’আলা ইবনে আল-লাজলাজ তাঁর সন্তানদেরকে বলেন, “তোমরা যখন আমাকে দাফন করবে এবং কবরের ‘লাহদ’ বা পার্শ্ববর্তী খোলা জায়গা স্থাপন করবে, তখন পাঠ করবে - বিসমিল্লাহ ওয়া ‘আলা মিল্লাতি রাসূলিল্লাহ - অর্থাৎ, মহান আল্লাহর নামে এবং মহানবী (ﷺ)-এর ধর্মীয় রীতি মোতাবেক। অতঃপর আমার ওপর মাটি চাপা দেবে এবং আমার কবরের শিয়রে সূরা বাকারা’র প্রারম্ভিক ও শেষের আয়াতগুলো তেলাওয়াত করবে; কারণ আমি দেখেছি হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه) তা পছন্দ করতেন।” 



রেফারেন্স



* ইমাম বায়হাকী, ‘আল-সুনান আল-কুবরা’ (৪:৫৬)

* ইবনে কুদামা, ’আল-মুগনী’ (২:৪৭৪, ২:৫৬৭, ১৯৯৪ ইং সংস্করণের ২:৩৫৫)

* আত্ তাবারানী, ‘আল-কবীর’; আর ইমাম হায়তামী নিজ ‘মজমা’ আল-যওয়াইদ’ (৩:৪৪) গ্রন্থে জানান যে এর সকল বর্ণনাকারীকেই নির্ভরযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে।


দলিল নং - ৮ 



ইবনে তাইমিয়া লিখেছে:



”বিশুদ্ধ আহাদীস বা হাদীসসমূহে প্রমাণিত হয় যে ইন্তেকালপ্রাপ্ত জন তাঁর পক্ষে অন্যান্যদের পালিত সমস্ত নেক আমলের সওয়াব বা পুরস্কার লাভ করবেন। কিছু মানুষ আপত্তি উত্থাপন করে এই মর্মে যে কোনো ব্যক্তি শুধু তার নিজের কর্মের ফলেই সওয়াব অর্জন করতে সক্ষম; আর তারা এ যুক্তির পক্ষে আল-কুরআনের দলিল দিতে তৎপর হয়। এটি সঠিক নয়। প্রথমতঃ ( এ কারণে যে) কোনো মুসলমান নিজে যে নেক আমল পালন করেননি, তার সওয়াব-ও তিনি পেতে পারেন; যেমনটি আল্লাহতা’লা কুরআন মজীদে এরশাদ ফরমান যে আল্লাহর আরশের ফেরেশতারা সর্বদা তাঁর-ই প্রশংসা করেন এবং সকল মুসলমানের পক্ষে মাফ চান। আল-কুরআনে আরও পরিস্ফুট হয় যে আল্লাহ পাক তাঁর-ই প্রিয়নবী (ﷺ)-কে নিজ উম্মতের জন্যে দোয়া করতে বলেছেন, কেননা তাঁর দোয়া উম্মতের মানসিক ও আত্মিক শান্তিস্বরূপ। অনুরূপভাবে, দোয়া করা হয় জানাযার নামাযে, কবর যেয়ারতে এবং ইন্তেকালপ্রাপ্তদের জন্যে



”দ্বিতীয়তঃ আমরা জানি, আল্লাহ পাক অন্যান্যদের নেক আমল, যা আমাদের পক্ষে তাঁরা পালন করেন, তার বদৌলতে আমাদেরকে পুরস্কৃত করে থাকেন। এর উদাহরণ হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর একখানি হাদীস যা’তে তিনি এরশাদ ফরমান, “কোনো মুসলমান যখন-ই অন্যান্য মুসলমানের জন্যে দোয়া করেন, তৎক্ষণাৎ আল্লাহ পাক একজন ফেরেশতা নিয়োগ করেন ‘আমীন’ বলার জন্যে; অর্থাৎ, ওই ফেরেশতা আল্লাহর কাছে দোয়া কবুলের জন্যে ফরিয়াদ করেন। কখনো কখনো আল্লাহতা’লা জানাযার নামাযে শরিক মুসলমানদেরকে ইন্তেকালপ্রাপ্তদের পক্ষে কৃত তাঁদের প্রার্থনার জবাবে রহমত-বরকত দান করেন; আর ইন্তেকালপ্রাপ্তদেরকেও এর বিপরীতে পুরস্কৃত করেন।”



 রেফারেন্স: ইবনে তাইমিয়া রচিত ‘মজমু’ আল-ফাতাওয়া’, সউদী আরবীয় সংস্করণ, ৭ম খণ্ড, ৫০০ পৃষ্ঠা এবং ২৪ খণ্ড, ৩৬৭ পৃষ্ঠা।



দলিল নং - ৯ [হাফেয ইবনে কাইয়্যেম জাওযিয়্যা]



”সুদূর অতীতের এক শ্রেণীর বোযূর্গ (এসলাফ) থেকে বর্ণিত আছে যে তাঁরা ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের দাফনের পর তাঁদের কবরের কাছে কুরআন পাক তেলাওয়াত করতে অসিয়ত করে গিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আব্দুল হক (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (رضي الله عنه) নির্দেশ দিয়েছিলেন তাঁর মাযারে যেন সূরা বাকারাহ পাঠ করা হয়। হযরত মুআল্লা ইবনে আব্দির রহমান (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-ও তদ্রূপ অভিমত পোষণ করতেন। ইমাম আহমদ (رضي الله عنه) প্রথমাবস্থায় উপরোক্ত মতের বিরোধী ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনিও কবরে কুরআন শরীফ পাঠ করার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন।



”হযরত আলা ইবনে লাজলাজ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) থেকে বর্ণিত: তাঁর পিতা অসিয়ত করেছিলেন যে তিনি ইন্তেকাল করলে তাঁকে যেন লাহাদ ধরনের কবরে দাফন করা হয় এবং কবরে মরদেহ নামানোর সময় ‘বিসমিল্লাহি ওয়া আলা মিল্লাতি রাসূলিল্লাহ’ বাক্যটি পাঠ করা হয়। আর মাটি দেয়ার পর তাঁর শিয়রের দিক থেকে যেন সূরা বাকারাহ’র প্রথম অংশের আয়াতগুলো পাঠ করা হয়। কেননা, তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (رضي الله عنه)-কে এ রকম বলতে শুনেছিলেন।

”এই প্রসঙ্গে হযরত আদ্ দুরী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, আমি একবার ইমাম আহমদ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কবরের কাছে কুরআন শরীফ পাঠ করা সম্পর্কে কোনো রওয়ায়াত আপনার স্মরণে আছে কি? তিনি তখন বলেছিলেন, ‘না’। কিন্তু হযরত ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-কে একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হলে তিনি আলা ইবনে লাজলাজ কর্তৃক উদ্ধৃত হাদীসটি বর্ণনা করেছিলেন। হযরত আলী ইবনে মূসা আল-হাদ্দাদ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, আমি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) ও হযরত মোহাম্মদ ইবনে কুদামাহ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর সঙ্গে এক জানাযায় শরীক হয়েছিলাম। লাশ দাফনের পর জনৈক অন্ধ ব্যক্তি কবরের কাছে পবিত্র কুরআন পড়তে লাগলেন। তখন ইমাম আহমদ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বল্লেন, ‘এই যে শোনো, কবরের কাছে কুরআন শরীফ পাঠ করা বেদআত।’ আমরা যখন কবরস্থান থেকে বেরিয়ে এলাম, তখন হযরত মোহাম্মদ ইবনে কুদামাহ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) ইমাম আহমদ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হযরত মোবাশশির হালাবী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) সম্পর্কে আপনার ধারণা কী? তিনি উত্তরে বললেন, হযরত মোবাশশির হালাবী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি। আমি আবার তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি তাঁর থেকে কোনো রওয়ায়াত লিপিবদ্ধ করেছেন কি? তিনি বল্লেন, ‘হ্যাঁ, করেছি।’ মোহাম্মদ ইবনে কুদামাহ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বল্লেন, ’আমাকে হযরত মোবাশশির (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি), আর তাঁকে হযরত আবদুর রহমান ইবনে আলা ইবনে লাজলাজ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি), আর তাঁকে তাঁর পিতা অসিয়ত করেছিলেন এই মর্মে যে তাঁর পিতার মরদেহ দাফন করার পর তাঁর শিয়রে যেন সূরা বাকারাহ’র প্রথম ও শেষ অংশ থেকে পাঠ করা হয়। তাঁর পিতা তাঁকে আরও বলেছিলেন যে তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (رضي الله عنه)-কে এই রকম করার জন্যে অসিয়ত করতে শুনেছিলেন।’ উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ইমাম আহমদ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) তাঁর মত পরিবর্তন করে ইবনে কুদামা (رضي الله عنه)-কে বলেন, ‘ওই অন্ধ ব্যক্তিকে গিয়ে বলো, সে যেন কবরে কুরআন শরীফ পাঠ করে’।”



রেফারেন্স  



* ইবনে কাইয়্যেম জাওযিয়্যা কৃত ’কিতাবুর রূহ’; বাংলা সংস্করণ ১৬-৭ পৃষ্ঠা; ১৯৯৮ ইং

* ইমাম গাযযালী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) রচিত ‘এহইয়া’, ইন্তেকাল ও পরকালের স্মরণবিষয়ক বই; ড: আবদুল হাকিম মুরাদ অনূদিত; ক্যামব্রিজ: ইসলামিক টেক্সটস্ সোসাইটি, ১৯৮৯; ১১৭ পৃষ্ঠা।

* আল-খাল্লাল এটি নিজ ‘আল-আমর বিল্ মা’রূফ’ শীর্ষক পুস্তকে বর্ণনা করেন; ১২২ পৃষ্ঠা # ২৪০-২৪১
*ইবনে কুদামাহ প্রণীত ‘আল-মুগনী’ (২:৫৬৭; বৈরুত ১৯৯৪ সংস্করণের ২:৩৫৫) এবং ‘ক্কা’ল আজি-ইন ফেকাহে ইবনে উমর’ (৬১৮ পৃষ্ঠা) 



ইমাম গাযযালী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) এতদসংক্রান্ত বিষয়ে (কবরে কুরআন তেলাওয়াত) তাঁর প্রারম্ভিক মন্তব্যে বলেন, ‘কবরের পাশে কুরআন তেলাওয়াত করাতে কোনো ক্ষতি নেই।’



ইবনে কাইয়্যেম জাওযিয়া আরও লেখে: “হযরত হাসান ইবনে জারবী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি তাঁর এক বোনের কবরের কাছে সূরা মুলক পাঠ করেছিলেন। পরে কোনো এক সময়ে এক ব্যক্তি তাঁকে এসে বললেন, আমি আপনার বোনকে স্বপ্নে দেখেছি; তিনি বলেছেন, ‘আমার ভাইয়ের কুরআন পাঠে আমার খুব-ই উপকার হয়েছে। আল্লাহ তাঁকে জাযায়ে খায়ের দান করুন।’



”হযরত হাসান ইবনে হাইসাম (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, আমি আবূ বকর ইবনে আতরূশ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-কে বলতে শুনেছি, এক ব্যক্তি নিজের মায়ের কবরের কাছে গিয়ে প্রতি জুমআ-বারে সূরা ইয়াসীন পাঠ করতেন। একদিন তিনি সূরা ইয়াসীন পাঠ করে আল্লাহর কাছে দোয়া চাইলেন, ‘হে আল্লাহ, এই সূরা পাঠ করলে যে সওয়াব পাওয়া যায়, তা আপনি এই কবরস্থানের সকল ইন্তেকালপ্রাপ্তের কাছে পৌঁছে দিন।’ পরের জুমআ-বারে তাঁর কাছে এক মহিলা এসে বললেন, আপনি কি অমুকের পুত্র অমুক? তিনি জবাবে বল্লেন, জ্বি হাঁ। ওই মহিলা বললেন, আমার এক মেয়ে মারা গিয়েছে। আমি তাকে স্বপ্নে দেখলাম, সে নিজের কবরের পাশে বসে আছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এখানে বসে আছো কেন? সে আপনার নাম উল্লেখ করে বললো, তিনি নিজের মায়ের কবরের কাছে এসে সূরা ইয়াসীন পড়েন এবং এর সওয়াব সমস্ত ইন্তেকালপ্রাপ্তের প্রতি বখশিয়ে দেন। সেই সওয়াবের কিছু অংশ অামিও পেয়েছি এবং সে জন্যে আমাকে মাফ করে দেয়া হয়েছে। আমার ওই মেয়ে আমাকে এ ধরনের আরও কিছু কথা বলেছিল।”



রেফারেন্স: ইবনে কাইয়্যেম আল-জাওযিয়্যা লিখিত ‘কিতাবুর রূহ’ বাংলা সংস্করণ, ১৭ পৃষ্ঠা; ১৯৯৮ ইং সাল।



”কোনো মো’মেন বান্দা যখন কোনো ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে দোয়া, এস্তেগফার, সাদকাহ, হজ্জ্ব প্রভৃতি নেক আমল পালন করেন, তখন এ সবের সওয়াব ইন্তেকালপ্রাপ্তদের রূহে পৌঁছে যায়। ..এক শ্রেণীর বেদআতী (ভ্রান্ত মতের অনুসারী)-র দৃষ্টিতে ইন্তেকালপ্রাপ্তদের কাছে জীবিতদের নেক আমলের সওয়াব পৌঁছে না। তবে সহীহ হাদীসে প্রমাণিত হয় যে এ ধারণা ভুল।...কুরআন মজীদেই এর প্রমাণ রয়েছে (সূরা আল-হাশর, ১০ম আয়াত), যেখানে মহান আল্লাহ পাক সে সকল মুসলমানের প্রশংসা করেন যাঁরা তাঁদের (অগ্রবর্তী) মুসলমান ভাইদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ...একটি বিশুদ্ধ হাদীস প্রতীয়মান করে যে মহানবী (ﷺ) এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, কোনো ইন্তেকালপ্রাপ্তের পক্ষে পেশকৃত সাদকাহ’র সওয়াব তাঁর রূহে পৌঁছে যায় (বোখারী ও মুসলিম)। ...কতিপয় লোক সন্দেহ করে থাকে যে পূর্ববর্তী তথা প্রাথমিক যুগের মুসলমানবৃন্দ ইসালে সওয়াব (ওরস) পালন করেননি; কিন্তু এটি ওই সব লোকের অজ্ঞতা বা জ্ঞানের অভাবে ঘটেছে। প্রাথমিক যুগের মুসলমানবৃন্দ প্রদর্শনীর উদ্দেশ্যে এগুলো করতেন না। ....মহানবী (ﷺ) স্বয়ং সাদকাহ প্রদানের অনুমতি দিয়েছিলেন। অতএব, ইসালে সওয়াব সঠিক। ...আল-কুরআনের যে আয়াতটিতে ঘোষিত হয়েছে কোনো ব্যক্তি শুধু সে সওয়াবটুকুই পাবেন যা তিনি আমল করেছেন, তাতে বোঝানো হয়েছে তাঁকে সওয়াব অর্জনের মতো যোগ্যতাসম্পন্ন নেককার হতে হবে; কিন্তু আল্লাহ পাক এ ছাড়াও অন্য কারো উপহৃত নেক আমলের সওয়াব ইন্তেকালপ্রাপ্তদের রূহের প্রতি বখশে দেন।”
 [ইবনে কাইয়্যেম জাওযিয়্যা কৃত ‘কেতাবুর রূহ’, ১৬তম অধ্যায়]
  
”হযরত শায়বী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, আনসার সাহাবা (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-দের কেউ ইন্তেকাল করলে তাঁরা তাঁর কবরের কাছে গিয়ে কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করতেন।
[প্রাগুক্ত ‘কেতাবুর রূহ’, ১৭ পৃষ্ঠা; বাংলা সংস্করণ]



”হযরত আল-হাসান ইবনে আস্ সাবাহ আয্ যাফরানী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, কবরের পাশে কুরআন শরীফ পাঠ করা সম্পর্কে আমি ইমাম শাফেঈ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি জবাবে বলেন, ’এতে আপত্তির কোনো কিছু নেই’।”
 [প্রাগুক্ত ’কেতাবুর রূহ’, ১৭ পৃষ্ঠা; বাংলা সংস্করণ]



দলিল নং - ১০ [কাজী শওকানী]

  

সুন্নী জামাআতের মতানুযায়ী, ইন্তেকালপ্রাপ্ত মুসলমানগণ (তাঁদের পক্ষে) অন্যদের পেশকৃত দোয়া, হজ্জ্ব, সাদকাহ ইত্যাদির বদৌলতে সওয়াব হাসেল করেন। কিন্তু মো’তাযেলা (ভ্রান্ত মতবাদী) সম্প্রদায় এ সত্য মানতে নারাজ। ইন্তেকালপ্রাপ্তদের উদ্দেশ্যে এগুলো পেশ করা যদি ভ্রান্তি-ই হতো, তবে কবরস্থানে যেয়ারত বা প্রবেশের সময় ইন্তেকালপ্রাপ্তদের প্রতি আমাদের সালাম দেয়াকেও ইসলাম ধর্ম অনুমোদন করতো না।”
 [কাজী শওকানী রচিত ‘নায়ল আল-আওতার’, জানায়েয অধ্যায়]


দাফনের পরে কবরের পাশে সূরা বাকারা’র প্রারম্ভিক ও শেষের আয়াতগুলো পাঠ করা হোক। এই সিদ্ধান্ত হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه)-এর কথার ভিত্তিতে নেয়া হয়েছে, যা বর্ণিত হয়েছে ইমাম বায়হাকী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর ’সুনান’ (৪:৫৬) গ্রন্থে এবং যা’তে বলা হয়েছে: ‘আমি পছন্দ করি কবরের পাশে সূরা বাকারা’র প্রারম্ভিক ও শেষাংশ পঠিত হোক।’



”ইমাম নববী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) ঘোষণা করেন যে (ওপরের) এই বর্ণনার এসনাদ হাসান (’হাসসানা এসনাদুহূ’); আর যদিও এটি শুধু হযরত ইবনে উমর (رضي الله عنه)-এরই বাণী, তথাপি তা স্রেফ কোনো মতামতের ভিত্তিতে উপস্থাপিত নয়। এটির সম্ভাব্য কারণ হতে পারে এই যে, তিনি সার্বিকভাবে আলোচিত এ ধরনের তেলাওয়াতের ফায়দাগুলো সম্পর্কে জেনেছিলেন, এবং এর গুণাগুণের আলোকে কবরের ধারে তা পঠিত হওয়াকে পছন্দনীয় ভেবেছিলেন এই আশায় যে এর তেলাওয়াতের দরুন ইন্তেকালপ্রাপ্ত মুসলমানবৃন্দ সওয়াব হাসেল করতে সক্ষম হবেন।” 
[শওকানী কৃত ‘তোহফাত আয্ যাকেরীন’, ২২৯ পৃষ্ঠা; আল-জাযুরী দামেশকী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর প্রণীত ‘হিসনে হাসিন’ গ্রন্থেও এই উদ্ধৃতি আছে]

Featured post

সালাতুল ইস্তেখারা নামাজের বর্ননা।।

  সালাতুল ইস্তেখারা নামাজ পড়ার নিয়ম Madina Madina Madina   আমরা এই নামাজ কেন পড়ব?  কোন কাজের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে, অর্...